জাহাজ এবং সাবমেরিন হামলা থেকে বাঁচার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা


টর্পেডো হামলা থেকে বাঁচার জন্য যুদ্ধজাহাজ/সাবমেরিনে কি ব্যবস্থা থাকে?
আশা করি এই পোস্টটির জন্যর অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন 😊
প্রথমেই টর্পেডো হামলা থেকে বাঁচতে যে কৌশল ব্যবহৃত হয় সেটা নিয়ে বলতে চাই।
জীগজ্যাগ ম্যানুভার:
এর মানে হলো সাপের মত আঁকাবাঁকা পথে জাহাজ চালানো,বারবার দিক পরিবর্তন করা।ওয়েক হোমিং টর্পেডো বাদে অন্যকোনো টর্পেডো মিসাইলের মত আপনার পিছনে পিছনে দৌড়াবে না।ওয়েক হোমিং যুদ্ধজাহাজের গতির ফলে উত্পন্ন পানির আলোড়নকে ফলো করে।এটা একটু পুরোনো টেকনোলজি।তবে এটা ঠেকানোর জন্য টাওয়েড টর্পেডো ডিকয় সিস্টেম আছে।সেটা নিয়ে পড়ে কথা বলবো।জীগজ্যাগ ম্যানুভার টর্পেডো হামলা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত কৌশল এবং এটাই সবচেয়ে কার্যকর এন্টি টর্পেডো সল্যুশন।আপনার সোনার এবং টর্পেডো এলার্ট সিস্টেম ভালোমানের হলে এই ম্যানুভার দিয়েই বেঁচে যেতে পারেন।
সাধারণত টর্পেডো জাহাজের গতি ক্যালকুলেশন করে এমনভাবে মারা হয় যেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের জাহাজটি তার বর্তমান গতির কারনে যেই পয়েন্টে অবস্থান করবে সেই পয়েন্টে গিয়ে যেন টর্পেডো হিট করে।একাজে পানিতে জাহাজের উত্পন্ন শব্দকে ব্যবহার করা হয় যা টর্পেডো ফলো করে।এটাও শতভাগ সফল পদ্ধতি নয়।কেননা টর্পেডো ফায়ার হলে জাহাজ তার সোনারের কারনে টের পেয়ে যায় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় (যেমন:জীগজ্যাগ)।
এজন্য no escape zone থেকে টর্পেডো ফায়ারের চেষ্টা করা হয় যাতে জীগজ্যাগ ম্যানুভার দিয়েও বাঁচতে না পারে।
অফ ব্যাক ফুল:
জাহাজ গাড়ির মত আচমকা ব্রেক করে থেমে পারে না।তবে ইন্জিন ফুল রিভার্সে দিয়ে গতি কমিয়ে ফেলা যায় এমনকি পিছন দিকেও যাওয়া যায়।উপরে যে রকম টর্পেডো হামলার কথা বললাম সেটা থেকে বাঁচতে এধরণের কৌশল ব্যবহার করা হয়।তবে এসব ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে এবং পুরোনো ইঞ্জিনের জাহাজের ক্ষেত্রে চীফ ইঞ্জিনিয়ারের অনুমতি ছাড়া ক্যাপ্টেন এই কাজ করতে পারেন না।ইন্জিন নষ্ট হলে কম গতির/স্থির জাহাজকে টর্পেডো মেরে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া সাবমেরিন/সারফেস শিপের জন্য ডালভাত টাইপের ব্যাপার।
ইমারজেন্সি ডাইভ বা ক্রাশ ডাইভ:
এটি সাবমেরিনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত কৌশল।এক্ষেত্রে একটি সাবমেরিন তার সর্বোচ্চ যত নীচে ডাইভ দেয়া সম্ভব তত নিচে ডাইভ দেয়।সাবমেরিনের জন্য বিভিন্ন ডেপথ সীমা দেয়া থাকে।ডিজাইন ডেপথ মানে সাবমেরিনের ডিজাইন এর উপরে বেজ করে করে যে ডেপথ এর সীমা নির্ধারণ করা হয়।এটি হচ্ছে সেফ ডাইভ লিমিট।এই গভীরতায় সাবমেরিনের কোনো ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ।অন্যদিকে টেস্ট ডেপথ হচ্ছে অপারেশন টাইমে যে সর্বোচ্চ গভীরতায় সাবমেরিন যেতে সক্ষম।এতে সাবমেরিনের বডির উপর হাজার হাজার লিটার পানির চাপ পড়ে কিন্তু সাবমেরিন তা ঠিকই সহ্য করতে পারে।সাধারণত টেস্ট ট্রায়াল এর সময় টেস্ট ডেপথ এর সর্বোচ্চ মান নির্ণয় করা হয়।
এবার আসি ক্রাশ ডাইভ এর বেলায়।মনে করুন টর্পেডোর তাড়া খেয়ে অথবা কোন কারনে সাবমেরিনের সিস্টেম ফেইলিউর হয়ে টেস্ট ডেপথ এর চেয়েও অনেক বেশি নিচে ডাইভ দিল।অর্থাৎ ডেঞ্জার জোনে চলে গেছে।এমন অবস্থায় সাবমেরিন এর মেটাল বডি যে সর্বোচ্চ গভীরে যেতে সক্ষম টা হলো ক্রাশ ডাইভ বা কলাপস ডাইভ।এর বেশি আর এক ইঞ্চিও যেতে পারবে না।গেলে প্রচন্ড পানির চাপে সাবমেরিন চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে! টর্পেডো থেকে বাঁচতে গভীরে ডাইভ দিয়ে সাবমেরিন নিজেকে বাঁচায়।ধাওয়া করা টর্পেডো যত নিচে দিকে যাবে ততই পানির চাপের কারণে লক্ষভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।এছাড়া তখনই ডিকয় ব্যবহার করে সাকসেসফুল হওয়া যায়।
👉এখন বলবো ডিকয় এর কথা।
টর্পেডো হামলার শিকার সারফেস ভেসেল বা সাবমেরিন,যেকোনোটাই হতে পারে।এজন্য ডিফেন্স সিস্টেমও ভিন্ন ভিন্ন।আমার সল্পজ্ঞানে যে কয়টা সম্ভব উল্লেখ করছি।
গানফায়ার ওয়েভ:
বিষয়টি অনেকটা রাইফেল দিয়ে মিসাইল ঠেকানোর চেষ্টা করার মত 😆
এটা মান্ধাতার আমলের ডিফেন্স সিস্টেম।শক্তিশালী নেভাল গানের কিছু কাস্টমাইজ হাই এক্সপ্লোসিভ শেল আছে যা ইনকামিং টর্পেডো প্যাথ বরাবর ফায়ার করা হয়।পানিতে বিস্ফোরিত হয়ে টর্পেডোর জন্য বাধা সৃষ্টি করে।মার্চেন্ট শিপ প্রোটেকশন এর জন্য আগে এই টেকনিক ব্যবহার করা হতো।পরবর্তীতে এন্টি সাবমেরিন মর্টার দিয়ে কাজ চালানো হয়।বর্তমানের হাইস্পিড টর্পেডোর বিপক্ষে এই কৌশল তেমন ইফেক্টিভ নয়।তবে বেশি দূর থেকে টর্পেডো ফায়ার করলে এবং পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেলে ডেপথ চার্জ দিয়ে টর্পেডোকে লক্ষভ্রষ্ট করা সম্ভব।
নয়েজ মেকার:
এটিই বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকর ডিকয় সিস্টেম।টর্পেডো জাহাজের উৎপন্ন শব্দকে ফলো করে।এজন্য আধুনিক যুদ্ধজাহাজগুলোতে এমন কিছু কাউন্টারমেজার সিস্টেম থাকে যা জাহাজের সমান বা তার চেয়ে বেশি শব্দ উত্পন্ন করতে সক্ষম।এগুলো মিসাইল ডিফেন্স কাউন্টারমেজার চ্যাফ এর মতই আলাদা ডিকয় লঞ্চার দিয়ে লঞ্চ করা হয়।(কিছু কিছু সিস্টেম আছে যেখানে চ্যাফ এবং এন্টি টর্পেডো ডিকয় একই লঞ্চার দিয়ে লঞ্চ করা যায়,এতে জাহাজের জায়গা কম লাগে)।টর্পেডো ডিকয় গুলো পানিতে পড়ে শব্দ উৎপন্ন করে টর্পেডোকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে এবং টর্পেডো ফলস টার্গেটে হিট করে।
আবার কিছু ডিকয় আছে যারা টর্পেডোকে নিয়ে কানামাছি খেলে 😂
যেমন DCNH এর CANTO® ১৩০এমএম এডভান্স টর্পেডো ডিকয়গুলো একসাথে কয়েকটি ফায়ার করলে একেকবার একেক ডিকয় নয়েজ সৃস্টি করে এবং টর্পেডো তার দিকেই দৌড়ায়।আবার সেই ডিকয় নয়েজ অফ করে দেয় এবং আরেক ডিকয় অন করে।তখন আরেক ডিকয় এর পিছনে দৌড়ায়।ভিডিও দেখলে ব্যাপারটা সহজে বুঝতে পারবেন।
BOLD decoy for submarine:
এটি নয়েজ মেকার টাইপের ডিকয় এর পুরাতন ভার্শন।পুরাতন মানে WW2 আমলের সাবমেরিনের এন্টি টর্পেডো ডিকয়।
কিন্তু এই জিনিস বর্তমান যুগেও খুবই ইফেক্টিভ এবং সহজে বানানো সম্ভব।এমনকি বৃটেনের রয়্যাল নেভির নিউক্লিয়ার সাবমেরিনসহ সহ আরো কিছু দেশের ডিজেল-ইলেক্ট্রিক সাবমেরিনে অত্যাধুনিক নয়েজ মেকার ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেজারের পাশাপাশি বা বিকল্প হিসেবে এবং cost effective ডিকয় হিসেবে এটি এখনও ব্যবহার করে।এটি মূলত calcium hydride যৌগ ভর্তি একটি বিশেষ ক্যানিস্টার যা পানিতে লঞ্চ করার সমুদ্রের লবণাক্ত পানির সাথে মিশে হাইড্রোজেন বুদবুদ সৃষ্টি করে ফলস টার্গেট সৃষ্টি করে।যেহেতু আমাদের ট্রেইনিং সাবমেরিন দুটোতে এন্টি টর্পেডো ডিকয় নেই সেহেতু এই পুরোনো টেকনোলজি এপ্লাই করা যেতে পারে।এটি সহজে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা সম্ভব এবং টর্পেডো টিউব দিয়ে লঞ্চ করা সম্ভব।এটি ৯৮ ফিট গভীরে একটানা ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত এক্টিভ থাকতে পারে।
এছাড়া Sieglinde নামের আরেক ধরনের সাবমেরিন লঞ্চড টর্পেডো ডিকয় আছে যা নিজে নিজে উপরে-নিচে আপ-ডাউন করে সত্যিকারের সাবমেরিনের মত সোনার সিগনেচার তৈরি করতে পারে।
টাওয়েড টর্পেডো ডিকয়:
নাম শুনে যুদ্ধবিমানের টাওয়েড রাডার ডিকয়(TRD) মনে করতে পারেন।তবে এটির কাজ হুবহু তেমন নয়।এটি আসলে মাল্টিস্ট্যাটিক সোনার যা সাবমেরিন ও ইনকামিং টর্পেডো থ্রেট শনাক্তের জন্য ব্যবহার করা হয়।এটি জাহাজের মূল সোনার এবং এয়ার/শিপ লঞ্চড এক্সটারনাল হাইড্রোফোনকে (যা এখানে-সেখানে ফেলে রেখে সবগুলোর মধ্যে ইন্টারলিংক করে একটি সমন্বিত সাবমেরিন হান্টিং ব্যবস্থা তৈরি করা হয়) নিয়ে বাড়তি একটি শক্তিশালী সোনার সিস্টেম তৈরি করা হয়।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এন্টি সাবমেরিন হেলিকপ্টার/বিমান দ্বারা এধরণের নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়।তবে জাহাজ থেকেও করা সম্ভব।টাওয়েড টর্পেডো ডিকয় জাহাজের পিছন দিকে ফাইবারের ক্যাবল যুক্ত করে লঞ্চ করা হয় এবং এটি জাহাজের সাথে সংযুক্ত থাকে।(প্রপেলারের সাথে কেটে যায় কিনা এমন আজাইরা প্রশ্ন করবেন না)।এটি অনেক দ্রুত সাবমেরিন সনাক্ত করতে সক্ষম এবং ইনকামিং টর্পেডো থ্রেট (ওয়েক হোমিং বা একুয়েস্টিক হোমিং বা ওয়্যার গাইডেড টর্পেডো) নিউট্রিলাইজ করতে সক্ষম।উদাহরণ হিসেবে AN/SLQ-25 Nixie এর কথা বলবো।এটি যুদ্ধজাহাজের জন্য বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সেরা টর্পেডো ডিফেন্স সল্যুশন যা TRD এর মতই কাজ করে।প্রতিটি Nixie ডিকয়ের দাম ১.৪৬ মিলিয়ন!!
বি:দ্র: ইহার চায়নিজ মামাতো ভাই আছে কিন্তু 😜
কিলার ডিকয়:
Nixie এর একটি ভার্শন যা হার্ড কিল টর্পেডো ডিফেন্স সিস্টেম।এটি নিজেই মূলত একটি ছোট সাইজের একুয়েস্টিক টর্পেডো!!
একুয়েস্টিক মানে যে শব্দ শুনে সেটিকে ফলো করে।এধরনের টর্পেডো ম্যানুয়ালি হাত দিয়ে জাস্ট পানিতে ফেলে দেয়া হয়।পরে অপারেটর একে এক্টিভেট করেন এবং কন্ট্রোল করেন।এটিও নয়েজ দিয়ে ফলস হিট সিগনেচার তৈরি করে।কিন্তু যেসব ঘাড়ত্যাড়া টর্পেডোকে বোকা বানানো সম্ভব নয় তাদেরকে ঠেকানোর জন্য এটি বানানো হয়েছে।এটি সরাসরি টর্পেডোর উপর মুখোমুখি হামলা চালিয়ে নিজে সহ টর্পেডো ধ্বংস করে জাহাজকে নিরাপদ রাখে।এটাও Nixie এর মত ১ মিলিয়ন+ দামি।তবে ব্যবহার না করলে একে তুলে রাখা যায়।
পরিশেষে:
যতই দিন যাচ্ছে ততই টর্পেডোগুলো পাল্লা দিয়ে আধুনিক হচ্ছে।ভবিষ্যতে মিড কোর্স গাইডেন্স সিস্টেম এবং অপারেটর গাইডেড টর্পেডো আসলে এসব ডিকয় দিয়েও কাজ হবেনা।আর টর্পেডো কোনরকমে একটা লাগাতে পারলেই বেশ ভালোমানের ক্ষতি করা সম্ভব এমনকি ডুবিয়ে দেয়াও সম্ভব।টর্পেডো আপনার আশেপাশে ফাটলেও ভালোই ক্ষতি হবে।এজন্য ডিকয় অনেকটা দূরে লঞ্চ করা হয় বা লঞ্চ এর পর সরে যাওয়া হয়।এন্টিশিপ মিসাইল নাহয় চ্যাফ বা ক্লোজ ইন ওয়েপন দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব কিন্তু টর্পেডোকে ডিকয় দিয়ে কাউন্টার করা বা জীগজ্যাগ প্যাথে চলে লাইন অব ফায়ার থেকে দ্রুত সরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।আমাদের বিএনএস বঙ্গবন্ধু, আবু বকর সহ আরো কিছু জাহাজে টর্পেডো ডিফেন্স সিস্টেম ইনস্টল করা আছে।এটা প্রয়োজন হলে ইনস্টল করা যায় আবার খুলেও রাখা যায়।যেমন বিএনএস সমুদ্র জয় এর গুলো খুলে রাখা হয়েছে(প্রয়োজন নেই বিধায়)।
Powered by Blogger.