এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডিওতে হঠাৎ ভেসে এল “ব্লুবার্ড ওয়ান সিক্স সিক্স ইজ হাইজ্যাকড
বেলা ১১টা বেজে ২৮ মিনিট
২০ আগস্ট, ১৯৭১
মাশরুর বিমানঘাঁটি, করাচি, পাকিস্তান।
এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডিওতে হঠাৎ ভেসে এল “ব্লুবার্ড ওয়ান সিক্স সিক্স ইজ হাইজ্যাকড…” মুহূর্তের ভেতর মাশরুর বিমানঘাঁটি সচকিত হয়ে উঠল। কর্তব্যরত এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আসেম রশীদ মেসেজটা শুনে মুহূর্তের জন্য অসার বোধ করলেন যেন। তিনি ধাতস্থ হয়ে ওঠার আগেই টি-৩৩ বিমানটা রানওয়ে ধরে হুঁস করে উড়ে বেরিয়ে গেল, তারপর নিয়ম মতো ডানে মোড় না নিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে দূর-দিগন্তে অদৃশ্য হয়ে গেল; বিমানটার কলসাইন[1] ছিল ‘ব্লুবার্ড-১৬৬।’
সামরিক বিমানঘাঁটি থেকে সামরিক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা হরদম ঘটে না। অবশ্য মার্চ মাসে ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের[2] পর থেকেই বাঙালি পাইলটরা বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করতে পারেন ভেবে পাকিস্তানিরা সতর্ক ছিল। সে কারণেই বাঙালি পাইলটদের ইতিমধ্যে গ্রাউন্ডেড[3] করে রাখা হয়েছে, যেন বিমানের ককপিটের ধারেকাছেও কেউ ঘেঁষতে না পারেন। কিন্তু অঘটনটা যে শেষ পর্যন্ত আর ঠেকানো গেল না তা এখন নিশ্চিত। তাই শুরুতে ধাক্কা খেলেও একমুহূর্ত পরেই রশীদ সংবিত ফিরে পেলেন।
রশীদ প্রথমেই ব্যাপারটা সেক্টর অপারেশনস কমান্ডারকে জানালেন, কিন্তু সংবাদটা তাকেও হকচকিত করে দিল, তাই সিদ্ধান্ত দেওয়ার বদলে তিনি একগাদা প্রশ্ন করতে থাকলেন। ধূর্ত রশীদ তার ফোনটা শেষ করেই সময় নষ্ট না করে সরাসরি এয়ার ডিফেন্স অ্যালার্ট হাটে[4] কল দিলেন। এয়ার ডিফেন্স অ্যালার্ট হাটে সব সময় দুটো যুদ্ধবিমান ওড়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় থাকে, ব্যাপারটাকে এয়ারফোর্সের ভাষায় বলে ‘স্ক্র্যাম্বলিং।[5]’
‘আ টি থার্টি থৃ ইজ বিইং হাইজ্যাকড, স্ক্র্যাম্বল…’, রশীদের আদেশ পাওয়ার পরপরই দুটো এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান আকাশে পাখা মেলল। পাশের বাদিক বিমানঘাঁটি থেকে আরও দুটো এফ-৮৬ ব্লুবার্ডকে খুঁজতে বেরোল। কিন্তু ব্লুবার্ড-১৬৬ খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বলে কোনো রাডারই এর অবস্থান শনাক্ত করতে পারছিল না। এফ-৮৬ যুদ্ধবিমানের পাইলটেরা তাই অন্ধের মতো আকাশের এপাশ-ওপাশ উড়তে লাগল, কিন্তু রেডিওতে ব্লুবার্ড-১৬৬ কে এমন সব হম্বিতম্বি করতে লাগল, যেন তারা সামনেই ব্লুবার্ডকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আর যেকোনো মুহূর্তে গুলি করে একে ভূপাতিত করতে যাচ্ছে। কিন্তু ব্লুবার্ড-১৬৬-এর রেডিও তখন সম্পূর্ণ নীরব। সময়ের হিসাব বলছে এতক্ষণে ব্লুবার্ড-১৬৬ পাকিস্তানের আকাশসীমা পেরিয়ে ভারতের আকাশে পৌঁছে গেছে। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে সবাই ব্লুবার্ডের পাকিস্তানি পাইলট মিনহাজকে ইজেক্ট[6] করে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিতে লাগল; ব্লুবার্ড-১৬৬-এর রেডিও তখনো সম্পূর্ণ নিরুত্তর।
সেদিন সকালেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান দিনের ফ্লাইং শিডিউল দেখে পাইলট অফিসার মিনহাজকে টার্গেট করে রেখেছিলেন। কী করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে মতিউর নিশ্চিত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আগের রাতেই তার পরিবারকে ভারতীয় দূতাবাসে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। সকালের দিকে আবহাওয়া কিছুটা খারাপ থাকায় তার পরিকল্পনাটা ভেস্তে যেতে বসেছিল প্রায়। কারণ নবীন পাইলটদের সোলো ফ্লাইঙের[7] জন্য আবহাওয়াটা বেশ খারাপই ছিল বলা চলে। কিন্তু ১১টার দিকে হঠাৎ আকাশটা পরিস্কার হয়ে গেল আর মতিউরের মুখেও হাসি ফুটল।
২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের রাতে মতিউর ছুটিতে নিজ গ্রামের বাড়ি রামনগরেই ছিলেন। দেখা করলেন ২ ইস্ট বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন নাসিম আর লেফটেন্যান্ট হেলালের সাথে। কিন্তু একজন পাইলট হয়ে স্থলযুদ্ধে তিনি কতটা অবদান রাখতে পারবেন, তা নিয়ে সবাই সন্দিহান ছিলেন। তাই আরও বড় একটা পরিকল্পনা নিয়ে তিনি পাকিস্তানে ফিরলেন।
একটা যুদ্ধের অনেক আঙ্গিক থাকে, রাইফেল হাতে ছাড়াও যোদ্ধা হওয়া যায়। পাকিস্তানিরা তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুক্তিযুদ্ধটাকে পাকিস্তানের সাময়িক আভ্যন্তরীণ সংকট বলে চালিয়ে দিতে। কিন্তু বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা তখন ভীষণ জরুরি। এমন অবস্থায় সামরিক বিমানঘাঁটি থেকে একটা সামরিক বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে বাধ্য। অগত্যা মতিউর পণ করলেন বিমান ছিনতাইয়ের।
কিন্তু তত দিনে পাকিস্তানিরা বাঙালি পাইলটদের গ্রাউন্ডেড করে ফেলেছে। একসাথে বসে সলাপরামর্শ করাটাও প্রায় অসম্ভব। তবে মতিউর আর তার পরিবার নিজেদের পাকিস্তানিদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখলেন, আর মনে মনে মোক্ষম একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন। ফাইটার বিমান ছিনতাই করাটা প্রায় অসম্ভব। নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যাপারটা তো আছেই। তা ছাড়া অন্যান্য গ্রাউন্ড ক্রুর[8] সহায়তা ছাড়া ফাইটার বিমান নিয়ে একাই আকাশে ওড়ার চেষ্টা করাটা বোকামিরই নামান্তর। তাই নবীন পাইলট অফিসারদের চালানো টি-৩৩ বিমানই আদর্শ টার্গেট।
মতিউর ছিলেন পাকিস্তানি পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজের প্রশিক্ষক আর সেফটি অফিসার। তাই তার বিমান নিয়ে টেক অফ[9] করার ঠিক আগমুহূর্তে মতিউরের ইশারা পেয়ে ইচ্ছে না থাকলেও বিমান থামালেন মিনহাজ। ট্যাক্সিংরত[10] ক্যানোপি[11] খোলা বিমানটা থামতেই মতিউর বিমানের পাখায় লাফিয়ে উঠে সোজা পাইলটের পেছনের দ্বিতীয় আসনটায় বসে গেলেন। তারপর মিনহাজের মুখের মাস্ক সরিয়ে ক্লোরোফর্ম ভেজা রুমালটা মিনহাজের নাকে চেপে ধরলেন। ধ্বস্তাধস্তি করতে করতে জ্ঞান হারালেন মিনহাজ। কিন্তু জ্ঞান হারানোর আগে বিমান ছিনতাইয়ের মেসেজটা ঠিকই দিয়ে গেলেন কন্ট্রোলে।
সোলো ফ্লাইংয়ের সময় টি-৩৩ বিমানের পেছনের সিটে প্যারাসুট থাকে না, তাই সিটটা অনেক বেশি নিচু হয়ে থাকে। এতে সুবিধা হলো, দূর থেকে মনে হবে পাইলট একাই আছেন বিমানে; কিন্তু অসুবিধা হলো, ককপিটে বসা একজন পাইলটের জন্য ঠিক যতটা দৃষ্টিসীমা থাকাটা জরুরি, ততটা পাওয়া যাবে না। অগত্যা প্রায় অন্ধের মতোই বিপজ্জনকভাবে টেক অফ করলেন মতিউর, তারপর নিয়ম অনুযায়ী ডানে টার্ন না নিয়ে বায়ে টার্ন নিয়ে যতটা সম্ভব নিচু দিয়ে উড়ে চললেন যেন রাডারে তার বিমানটার অবস্থান ধরা না পড়ে। পেছনে স্ক্র্যাম্বল করে ছুটে আসা ফাইটার বিমানের হাত থেকে বাঁচতে হলে এর বিকল্প নেই।
ক্লোরোফর্মের ঘোর কাটিয়ে মিনহাজের জ্ঞান ফিরতে শুরু করেছে, ওদিকে ককপিটের রেডিওতে মিনহাজকে বারবার ইজেক্ট করার নির্দেশ ভেসে আসছে। তরুণ মিনহাজের জায়গায় অভিজ্ঞ মতিউর হলেও তাই করতেন। কারণ, সোলো ফ্লাইংয়ের সময় পেছনের সিটের বেল্ট-স্ট্র্যাপ সব সিটের সাথে শক্ত করে বাঁধা থাকে, যেন বিমান মেনুভারের[12] সময় বেল্টের আঘাতে ককপিটের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয়। তার ওপর পেছনের সিটে কোনো প্যারাসুটও নেই। তাই এই মুহূর্তে ইজেকশন সুইচ চাপা মানেই টি-৩৩-এর মেকানিজম অনুযায়ী প্রথমেই পেছনের সিট ইজেক্ট করবে। আর ইজেক্ট করা মানেই বেল্ট-প্যারাসুট পরে না থাকার কারণে পেছনের সিটে বসা মতিউরের অবধারিত মৃত্যু।
তা ছাড়া মিনহাজ যদি হঠাৎ নিরুপায় হয়ে বিমানের ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়, তাহলেও বাঁচার সব আশা শেষ। অগত্যা প্রাণ বাঁচানোর সহজাত তাগিদেই মতিউর পেছন থেকে জাপটে ধরে যেকোনো উপায়ে মিনহাজকে আটকে রাখতে চেষ্টা করলেন। টি-৩৩-এর অপরিসর ককপিটজুড়ে শুরু হলো অপার্থিব এক দ্বৈরথ।
এরই মধ্যে আচমকা বিমানের ককপিটের ক্যানোপিটা হাঁ করে খুলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে খুব দ্রুত কিছু ঘটনা ঘটে গেল। মতিউর বা মিনহাজ কেউই টেক অফের আগে বিমানের ক্যানোপি ঠিকমতো লক হয়েছিল কি না, তা পরীক্ষা করার সুযোগ পাননি। তাই আকাশে এসে ক্যানোপিটা খোলা মাত্র তা বাতাসের ধাক্কায় ভেঙে উড়ে গিয়ে বিমানের টেইলে আঘাত করল। মতিউর বিমানে ওঠার পর নিজের বেল্ট স্ট্রাপ কিছুই লাগানোর সুযোগ পাননি। তাই ক্যানোপি উড়ে যাওয়ার সাথে সাথে প্রচণ্ড বাতাসের হ্যাঁচকা টানে মুহূর্তেই ককপিটের বাইরে ছিটকে গিয়ে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়লেন তিনি।
ক্যানোপির আঘাতে টেইল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আর মতিউর বেরিয়ে যাওয়ার পর ককপিটের ভেতর বাতাসের চাপের তারতম্য মিলে বিমানটা যেন একমুহূর্তের জন্য আকাশেই কড়া ব্রেক কষল, তারপর মতিউরের প্রাণহীন দেহের কাছেই মাটিতে গোত্তা খেল।
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম মতিউর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী
মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈতৃক বাড়ি ‘মোবারক লজ’-এ জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে মতিউর ষষ্ঠ। তার বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ডিস্টিংকশন সহ ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯৬১ সালে তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পিএএফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করেন এবং জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর করাচির মৌরিপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্ত করে পেশোয়ারে গিয়ে জেটপাইলট হন। ১৯৬৫-তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুটযোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু’বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭০-এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।
চাকরিজীবনে তিনি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমানের পাইলট হিসেবে ১৯নং ফাইটার স্কোয়াড্রন ও ২৫নং স্কোয়াড্রনে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন । প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিমানবাহিনী একাডেমি, রিসালপুরে ও ২নং স্কোয়াড্রনে। এ ছাড়া তিনি কিছুকাল আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সদর দপ্তর, ইসলামাবাদেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে এক পাঞ্জাবি পাইলটের সাথে প্রশিক্ষণকালীন আকাশযুদ্ধে লিপ্ত হলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং তিনি বেইল আউট[13] করেন। এ ঘটনায় তাদের উভয়কেই কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি করা হয়। বিচারে পাঞ্জাবী পাইলটের শাস্তি না হলেও তাকে এক বছরের জন্য গ্রাউন্ডেড করা হয়।
১৯৬৮ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি মিলি খানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৯ সালের ২৩ এপ্রিল তাদের প্রথম কন্যাসন্তান মাহিন ও ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কন্যাসন্তান তুহিনের জন্ম হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে বার্ষিক ছুটিতে তিনি সপরিবারে ঢাকায় আসেন। এ সময় তিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১ মার্চ কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি। ২৫ মার্চ গ্রামের বাড়ি নরসিংদী গমন করেন এবং সেখানকার স্বাধীনতাকামী জনতার প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করেন। ৪ এপ্রিল পাকিস্তান বিমানবাহিনী নরসিংদীর ওপর বিমান হামলা চালালে তিনি ভৈরব হয়ে নানার বাড়ি গোকুল নগরে গমন করেন। পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাইয়ের মানসে ৯ মে ১৯৭১, তিনি সপরিবারে কর্মস্থলে ফিরে যান। কর্তৃপক্ষের কাছে দেরিতে যোগ দেওয়ার কারণ দর্শানোর পর তাকে ফ্লাইং সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মাশরুর বিমানঘাঁটির ৬৪ নটিক্যাল মাইল দূরে যেখানে মতিউরের বিমানটা বিধ্বস্ত হয়, সেখান থেকে আর মাত্র তিন মিনিটের পথ দূরেই ছিল ভারত সীমান্ত। ভারতীয়রা পাকিস্তানিদের কথোপকথন ইন্টারসেপ্ট করে ততক্ষণে মতিউরের কথা জেনে গিয়েছিল এবং কিছু ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভারতের আকাশে ঢোকার পর মতিউরের বিমানকে পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান থেকে বাঁচাতে আকাশে টহলও দিচ্ছিল।
অনেকের মতে, মতিউর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মিনহাজকে প্রাণে মারতে চাননি। কারণ, পেছনের নিচু সিটে বসে সীমাবদ্ধ দৃষ্টিসীমা নিয়ে বিমানটাকে নিরাপদে নিকটস্থ ভারতীয় বিমানঘাঁটি পর্যন্ত নিয়ে যেতে মিনহাজের সহায়তা তার দরকার ছিল। আর এ কারণে জ্ঞান ফেরার পর পেছন থেকে একটা পিস্তল ঠেকিয়ে তিনি মিনহাজকে বিমান চালাতে বাধ্য করতে চেষ্টা করেছিলেন। মতিউর রহমান তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা কতটা ব্যাকুল আর উদগ্রীব ছিলেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দাফন হয়েছিল পাকিস্তানের করাচির মাশরুর বেসের চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। কবরের সামনে লেখা ছিল, ‘ইধার শো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’। প্রায় ৩৫ বছর ওখানে ছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ২০০৬ সালের ২৩ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়।
পুনশ্চ
এই একই ঘটনায় বাংলাদেশ মতিউর রহমানকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে আর পাকিস্তান মিনহাজকে নিশান-ই-হায়দার উপাধিতে ভূষিত করে। একই ঘটনায় উভয় দেশের দুজনের সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক পদক প্রাপ্তির দৃষ্টান্ত সত্যি বিরল।
ফুটনোট
১. প্রতিটি বিমানকে আলাদা করে চেনার জন্য দেওয়া ডাক নাম।
২. ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংস গণহত্যা।
৩. বিমান নিয়ে আকাশে উড্ডয়নের অনুমতি না পাওয়া পাইলট।
৪. কোনো শত্রু বিমান নিজ দেশের আকাশে প্রবেশ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার কর্তৃপক্ষ।
৫. কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক যুদ্ধ বিমান জরুরী অবস্থায় যেকোনো সময় উড়বার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত করে রাখা হয়। ডিউটি পাইলট আর ক্রুরাও কাছাকাছি থাকে। স্ক্র্যাম্বেল আদেশ পাওয়া মাত্র ন্যূনতম সময়ে এরা আকাশে উঠে শত্রুবিমান ধাওয়া করে।
৬. পাইলটের নিরাপত্তার স্বার্থে বিমান ফেলে প্যারাসুটসহ নেমে আসা।
৭. একটি দুই সিটের বিমান যখন একজন পাইলট একা উড্ডয়ন করেন।
৮. বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িত সদস্যগণ।
৯. রানওয়ে থেকে আকাশে ওড়া।
১০. বিমান হ্যাঙ্গার থেকে রানওয়েতে এগিয়ে আসা।
১১. পাইলটের মাথার ওপরের স্বচ্ছ ঢাকনা।
১২. ডান-বাম, আগু-পিছু, উপর-নিচে চলাচল।
১৩. বিমান ত্যাগ করে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ।
লেখকঃ Del H Khan স্যার