বাংলার ইতিহাসের সলুক সন্ধানে | পর্ব-১


** লাইকদিন আমাদের ফেইসবুক ফ‌্যান পেইজে: রোমান্চকর সামরিক বিষয়
বাংলার ইতিহাসের কথা বললে আমাদের একেক জনের ইতিহাস একেক পিরিয়ড থেকে শুরু হয়। কারো ইতিহাস একাত্তর থেকে, কেউ পলাশী থেকে আবার কেউ সাকুল্যে পাল বা সেনদের সময় থেকে শুরু করে। ইতিহাস সংরক্ষনে আমরা সাদাদের মত সিরিয়াস নই। অথচ ১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিস্কার করেন, তখন দিল্লীর সালতানাত শাসন করছেন লোদী বংশের ২য় সুলতান সিকান্দার লোদী আর বাংলায় হুসেন শাহী বংশের গোড়াপত্তন করেছেন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ!
চলুন তাহলে, চেস্টা করা যাক বাংলার ইতিহাসের সলুক সন্ধানেরঃ
যিশু খ্রীস্টের জন্মের ১৫০০ বছর আগে থেকে ৫০০ বছর আগ পর্যন্ত সময়টাকে বলে বৈদিক যুগে। তখন বাংলা নামে কোনো অখন্ড রাষ্ট্ৰ ছিল না। বাংলার বিভিন্ন অংশ তখন বঙ্গ, পুণ্ড্ৰ, গৌড়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্ৰ এরকম প্ৰায় ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ অঞ্চল বা বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকে গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গাহৃদি বা গঙ্গারাঢ়ী (Gangaridai) রাজ্য গড়ে উঠেছিল। গঙ্গাঋদ্ধির পরাক্রম আর ক্লান্ত গ্রীক সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহের সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে আলেকজান্ডার তার বঙ্গ জয় অভিযানে ইস্তফা দিয়েছিলেন।


৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ বাংলা ছিল মৌর্য্য রাজবংশ দ্বারা শাসিত। চানক্য তথা কৌটিল্যের কূট চালে আর রাজা চন্দ্রগুপ্তের শৌর্যে নন্দ রাজবংশ উচ্ছেদ করে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে মৌর্য্য সাম্রাজ্যর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য আর কখনো তৈরী হয়নি। মৌর্য্য অশোকের মৃত্যুর পর ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
সুবিশাল মৌর্য্য সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা ভারত বর্ষেই ক্ষমতার পালাবদল চলতে থাকে আর বাংলা থিতু হয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের উদয়ের মধ্য দিয়ে। ৩২০ থেকে ৫৫০ সাল অবধি শুধু বাংলাই নয় বরং ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল এবং সময়টাকে বলা হত স্বর্ণযুগ। তবে এ সময়কালে ক্ষমতার কেন্দ্র মধ্যভারত কেন্দ্রিক হওয়ায় বাংলায় স্বীকৃত ও পৃথক কোনো রাজ বংশ গড়ে উঠেনি বরং বঙ্গ, সমতট ও গৌড়ের মত ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল এবং রাজা মহাসেন গুপ্ত বাংলা শাসন করতে থাকে।
মহাসেন গুপ্তের মৃত্যুর পর ৫৯০ সালে প্রথম বাঙালি সম্রাট ও প্রথম স্বাধীন বাঙালি নৃপতি হিসেবে সামন্তরাজ শশাঙ্ক বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা। তিনি আলাদা বাংলা ক্যালেন্ডার প্রচলন করেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা রাজ্যবর্ধনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন শশাঙ্ক। যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন নিহত হলে ভাই হর্ষবর্ধন রাজা হন এবং শশাঙ্ক-হর্ষ দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তার সন্তান মানব আট মাস ধরে গৌড় রাজ্য শাসন করেন। পরে গৌড় রাজা হর্ষবর্ধন ও কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মনের অধীনস্থ হয় ও ভাস্করবর্মন সফলভাবে কর্ণসুবর্ণও দখল করে নেন।
শশাঙ্কেদের পতনের পর বাংলায় চরম নৈরাজ্য দেখা দেয়। কেন্দ্রীয় কোনো শাসক না থাকায় ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতিরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। ইতিহাসে সময়টিকে ‘মাৎস্যন্যায়’ (অর্থাৎ বড়ো মাছ যেমন ছোটো মাছকে খেয়ে ফেলে, সেই রকম অবস্থা) বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘মাৎস্যন্যায়’ (আনুমানিক ৬৫০ থেকে ৭৫০ সাল) এর সময় দেশের জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত ছিল না। ব্যবসাবাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রৌপ্যমুদ্রার আদানপ্রদান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সর্বোপরি বাংলার প্রধান বন্দর তাম্রলিপ্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং ফলস্বরূপ, বাংলা সবদিক থেকেই অন্যান্য ভারত বর্ষীয় রাজ্য থেকে দারুনভাবে পিছিয়ে পরে।
.৭৫০ সালে বাংলার সামন্ত গোষ্ঠীপতিরা মিলে গোপাল নামের এক জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে বাংলার রাজা নির্বাচিত করেন এবং পাল রাজবংশের সূচনা হয়। কিন্তু ৯৪০ সালে পাল সাম্রাজ্যের নবম সম্রাট ২য় গোপাল ক্ষমতা আরোহনের পর পরই বাংলার উপর আধিপত্য হারান এবং শুধুমাত্র বিহার অঞ্চল শাসন করেন। পরবর্তীতে রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালে পাল সাম্রাজ্য গৌড়, রাঢ়, অঙ্গ ও বঙ্গ প্রভৃতি ছোটো ছোটো রাজ্য বিভাজিত হয়ে যায়।
 ৯৮৮ সালে ১ম মহীপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিন বছরের মধ্যেই তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু ১০৮০ সালে রাজা ২য় মহীপাল কৈবর্ত (ধীবর) বিদ্রোহের সম্মুখীন হন এবং দিব্য (বা দিব্বক) নামে এক কৈবর্ত নেতার হাতে প্রান হারালে বরেন্দ্র অঞ্চল পালদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
বারেন্দ্র 'সামন্তচক্রের' বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে বিজয় সেন পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন এবং পাল রাজবংশের শেষ রাজা মদন পালকে তার রাজধানী গৌড় থেকে বিতাড়িত করেন। মদন পাল উত্তর বঙ্গে পলায়ন করেন এবং পরবর্তী আট বছর সেখানে পাল বংশের শাসন কায়েম রাখেন। ১১৫২-৫৩ খ্রীস্টাব্দে মদন পালের মৃত্যুর পর বিজয় সেন সমগ্র উত্তরবঙ্গ অধিকার করে নেন।
১২০২ সালে তুর্কি সামরিক নেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বাংলার অস্থায়ী রাজধানী নদিয়া আক্রমণ করেন। তুর্কিদের দ্বারা অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে বৃদ্ধ লক্ষ্মণ সেন নৌকাযোগে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। নদিয়া তুর্কি শাসনে চলে গেলেও লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গ থেকে বাংলা শাসন করতে থাকেন। লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলায় সেন শাসন দুর্বল হতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্ত বিদ্রোহের ফলে ১২৩০ সালে সেন রাজ্যের পতন ঘটে।
(চলবে...)

Powered by Blogger.