অপারেশন বেলুগা, রাশিয়া


রাশিয়ায় শীতকাল মানেই বরফের চাদরে মোড়া এক রূপকথার পৃথিবী, কিন্তু ১৯৮৪ সালের শেষ দিকে সাইবেরিয়ার চুকচি সাগরে তিন হাজারের বেশি বেলুগা তিমির কাছে সেই বরফই যেন এক ভয়ংকর ফাঁদ হয়ে ধরা দেয়। তারা বরফের কারণে খোলা সাগরে ফিরে যেতে পারছিলো না।


বেলুগা তিমি আসলে একটি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, তাই তাদের ফুসফুস রয়েছে এবং মাছের মতো ফুলকা নেই। এ কারণে তারা জলের নিচে শ্বাস নিতে পারে না, বরং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্বাস ধরে রাখতে পারে—সাধারণত ১৫–২০ মিনিট পর্যন্ত, কিছু ক্ষেত্রে প্রায় ২৫ মিনিটও। শ্বাস নেওয়ার জন্য তাদের মাথার উপরের দিকে একটি বিশেষ শ্বাসরন্ধ্র বা ব্লোহোল থাকে। ফলে নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের উপরিভাগে উঠে এসে বাতাস গ্রহণ করতে হয়। এই কারণেই ১৯৮৪–৮৫ সালে বরফে আটকে পড়া অবস্থায় তাদের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে—বরফের স্তর ভেদ করে উপরে উঠে শ্বাস নেওয়া অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল, আর তারা বাঁচার জন্য শুধু ছোট ছোট খোলা জলাশয়ের ওপর নির্ভর করছিল।

তিমিগুলোর করুণ অবস্থা দেখে স্থানীয় শিকারীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, বরফ ভেঙে পথ তৈরি করার চেষ্টা করেন, এমনকি মাছ দিয়েও তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু এতো বড় বিপদ থেকে তাদের পুরোপুরি বাঁচানো সম্ভব ছিল না।
এরপর ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই তিমিদের উদ্ধারের জন্য মাঠে নামে তৎকালীন সোভিয়েত সরকার। পাঠানো হয় তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী বরফভাঙা জাহাজ 'এডমিরাল ম্যাকারভ' যার ডাকনাম ‘মস্কভা’। প্রায় ১১৪ মিটার লম্বা এবং ১৪,৩০০ টনের বিশাল এই জাহাজটি বরফ ভেঙে একটি ৪ কিলোমিটার (আরেক যায়গায় দেখলাম ১৫ কিলোমিটার লিখেছে) লম্বা সরু পথ তৈরি করতে থাকে। কিন্তু তিমিগুলো জাহাজটার বিকট শব্দ আর বিশাল আকার দেখে ভয়ে আরও দূরে সরে যেতে থাকে।

ঠিক সেই মুহূর্তে এক দুঃসাহসী বুদ্ধি আসে। জাহাজের একজন নাবিক মনে করেন, তিমিরা তো সুর ভালোবাসে। যেই ভাবা সেই কাজ—জাহাজ থেকে শুরু হয় উচ্চস্বরে ক্ল্যাসিকাল সংগীতের সুর, বিশেষ করে চাইকোভস্কি ও মোৎসার্টের মতো বিখ্যাত সুরকারদের গান। আর এই সুরের জাদুতে বরফ-কঠিন মন গলে যেতে থাকে তিমিদের। জাহাজটি ধীরে ধীরে বরফ ভেঙে, এগিয়ে আর পিছিয়ে, তিমিদের যেন বোঝাতে থাকে পথটা এখন খোলা। ৪ দিনের মধ্যে তারা ভয় কাটিয়ে জাহাজের পাশে এসে খেলাধুলা করতে শুরু করে। এরপর তারা একে একে সেই সুরের পিছু নিয়ে, জাহাজের তৈরি করা পথ ধরে এগিয়ে যায় মুক্ত সাগরের দিকে।
অপারেশন বেলুগা, রাশিয়া

কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা এই অভিযানে প্রায় দুই হাজার তিমি নতুন করে জীবনের স্বাদ পায়। যদিও ৫০০-এর বেশি তিমি ততদিনে শিকার বা বরফের কবলে মারা গিয়েছিল। সেই সময় এই অভিযানের আনুমানিক খরচ ছিল ৮০ হাজার ডলার, যা বর্তমানের হিসাবে প্রায় দুই লক্ষ ডলারের সমান। এই অকল্পনীয় ঘটনা আজও 'অপারেশন বেলুগা' নামে পরিচিত।
এটি প্রমাণ করে, অনেক সময় প্রযুক্তি আর সাহসের সঙ্গে যদি শিল্প আর সংবেদনশীলতার মিশেল ঘটে, তবে অসম্ভবও সম্ভব হয়।
কপিরাইট: #ব্রাভো_সিক্স, সমরাঙ্গন।
Powered by Blogger.