বে অব পিগস আক্রমণ এবং সিআইএ এর শোচনীয় পরাজয়

 

সিআইএ সমর্থিত ব্রিগেড ২৫০৬ এর সদস্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে কাস্ত্রো অনুগত বাহিনী

বে অব পিগস মূলত আমেরিকা দ্বারা ১৯৬১ সালে পরিচালিত পরিচালিত কিউবায় রেজিম চেঞ্জ প্রোগ্রাম যেটার মাধ্যমে সিআইএ সরাসরি আক্রমণ করে কাস্ত্রোকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। ১৯৫৮ সালে ফিদেল কাস্ত্রো বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে কিউবায় সমাজতন্ত্রের সূচনা করেন। আমেরিকার নাকের ডগায় অবস্থিত কিউবায় সমাজতন্ত্রের উত্থান মার্কিন প্রশাসনকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। আপনারা জানেন, তখনকার সময়টা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের যা মূলত পুজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র অর্থ্যাৎ দুইটা আদর্শের লড়াই। তাই স্বাভাবিকভাবেই পুজিবাদি আমেরিকা তাদের এত কাছাকাছি কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মেনে নিতে রাজি ছিলনা। ফলাফল শুরু হয় কাস্ত্রো বনাম আমেরিকা দ্বন্দ্ব!

আমেরিকা প্রথমেই কাস্ত্রোর প্রশাসনকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবরোধের কাবু করার চেষ্টা করে। ফিদেল কাস্ত্রোও কিউবায় থাকা আমেরিকান ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করা সম্পত্তি একে একে রাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে ইটের জবাব পাথরের মাধ্যমে দিয়ে দেন! মার্কিন প্রশাসন বুঝলো ঘি সোজা আঙ্গুলে উঠবেনা। এবার তারা প্রতিবিপ্লবীদের দ্বারা বিভিন্ন রকমের স্যাবোটেজ শুরু করে। ফিদেল কাস্ত্রোও এবার বসে থাকার পাত্র না! "ক্ষমতায় বইছি কি তোগো ম্যাড়ম্যাড়ানি সহ্য করার লাইগ্যা?" টাইপ রিয়্যাকশন দেখিয়ে উনি প্রতিবিপ্লবীদের উপর ক্র্যাক ডাউন শুরু করেন। ফলাফল অনেক প্রতিবিপ্লবী গ্রেপ্তার হয় এবং বিপুল পরিমাণ কাস্ত্রোবিরোধী কিউবান আমেরিকায় নির্বাসিত হয়। 
 
 
কাস্ত্রো যখন এইভাবে ক্রমাগত আমাদের আংকেল স্যামের মাথার ব্যাথা বাড়িয়ে দিচ্ছেন তখন প্লটে হাজির হয় সকল কাজের কাজি বিশ্বসেরা গোয়েন্দা সিংস্থা সিআইএ! মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সম্মতি নিয়ে তারাও কাজে নেমে পড়ে। মূলত আমেরিকায় থাকা কিউবান শরনার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য ছিল বাতিস্তা আমলের কিউবান সেনা সদস্য। এদের সামরিক ট্রেনিং তো ছিলই, তারপরেও সিআইএ মিয়ামি দ্বীপে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এদের থেকে বাছাই করা ১৪০০ প্যারামিলিটারি নিয়েই গঠন করা হয় ব্রিগেড ২৫০৬ যারা ১৭ এ এপ্রিল কিউবায় আক্রমণ করার জন্য এখনো ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। 
 
ততদিনে আমেরিকান প্রশাসনেও রদবদল এসে গেছে। আইজেনহাওয়ারের পরিবর্তে এবার ক্ষমতায় বসেছেন জন এফ কেনেডি। তার থেকে অপারেশনের গ্রীন সিগন্যাল নিতে সিআইএ এর একটু কাঠ খড় বেশিই পুড়িয়ে ফেলতে হয় কারণ কেনেডি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়ানোর বিরোধী ছিলেন। তা স্বত্তেও অনেকটা অনিচ্ছায় তাকে এপ্রুভাল দিতে হয়। 
 
অপারেশনের প্রাথমিক পর্যায়েই ১৭ই এপ্রিল আমেরিকান বিমানবাহিনীর কয়েকটি বি ২৬ বোমারু বিমান যেয়ে কিউবান এয়ারস্ট্রিপগুলোতে বোমা বর্ষণ করে আসে ফলে উল্লেখযোগ্য কিউবান বিমানসদস্য নিহত হয়। ঠিক সেইদিনই রাতেই কিউবার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় প্লায়া গিরন উপকূলে ব্রিগেড ২৫০৬ এর মিলিশিয়ারা ৫টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন এবং একটি প্যারাট্রুপার দলে বিভক্ত হয়ে ছোট খাটো ডি ডে ল্যাংডিং সম্পন্ন করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল ঝটিকা আক্রমণ করে সরাসরি হাভানার দিকে এগিয়ে যাওয়া সেই সময়ে সেখানে ছোট কাস্ত্রো অনুগত মিলিশিয়া গ্রুপ ছাড়া প্রতিরোধ করার তেমন কেউ ছিলনা। তারা প্রতিরোধ করতে ব্যার্থ হলেও ঠিকই কিউবান সদর দপ্তরে আক্রমণের খবর পৌছে দেয়।
ফিদেল কাস্ত্রো বসে থাকার পাত্র না। উনিও সর্বাত্মক প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও খবর ছড়িয়ে পড়লে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর তীব্র নিন্দা জানাতে থাকে৷ কেনেডি প্রশাসন অনেকটা চাপে পড়েই এয়ার স্ট্রাইক বন্ধের নির্দেশ দেন। 
 
এবার আমরা ফিরি কিউবার উপকূলে, কাস্ত্রো সর্বাত্মক প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে কিউবান বিমান বাহিনী প্রতিবিপ্লবীদের অবস্থান আর সাপ্লাই শিপের উপর ব্যাপক হারে এয়ারস্ট্রাইক শুরু করলে ব্রিগেড ২৫০৬ দিশেহারা হয়ে পড়ে। আহত সদস্যদের পিছু ফেলেই তারা সীমিত অস্ত্র আর গোলা বারুদ নিয়ে কিউবার মূল শহরগুলোতে আক্রমণ চালালে ব্যাপক প্রতিরোধের শিকার হয়। এই সময় সিআইএ তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। প্রায় দুই দিনের তীব্র যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯ এপ্রিল ১৯৬১ সালে তারা আত্মসমর্পণ করে। প্রথমে তাদের বন্দী করে রাখলেও কাস্ত্রো প্রশাসন পরবর্তীতে অনেক বন্দীদের ছেড়ে দেয়। 
 
বে অব পিগস অপারেশন ছিল সিআইএ এর অন্যতম ব্যার্থ অভিযান একই সাথে জন এফ কেনেডির কূটনীতিক পরাজয়। এতে যেমন কেনেডি প্রশাসন দেশের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে থাকে তেমনই সিআইএ কেও কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি৷ অন্যদিকে, এই আক্রমণের ফলে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর ভাবমূর্তি তো উজ্জ্বল হয়েই উঠে এমনকি তার ক্ষমতাও সুসংহত হয়! কাস্ত্রোর বিশ্বস্ত সহচর চে গুয়েভারা তো প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে ব্যাঙ্গাত্মক চিঠিই লিখে বসেন, " আক্রমণের জন্য ধন্যবাদ! এতদিন বিপ্লব ঝিমিয়ে পড়েছিলো, এখন তা চাঙ্গা হয়ে উঠল" এই ঘটনা ঐতিহাসিক গুরুত্ব খুব কম নয়! এই আক্রমণের কারণেই পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে "কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস " নামক দীর্ঘমেয়াদী কূটনীতিক সংকট শুরু হয়। সেটা নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে। 
 
©Fardin Hossain. সমরাঙ্গন।


নিয়মিত রোমাঞ্চকর সামরিক বিষয়ক পোষ্ট পেতে লাইক দিন আমাদের ফেইসবুক ফ‌্যান পেইজে- Click here

Powered by Blogger.