বাংলাদেশে রূপপূর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।। বিশ্লেষন মূলক প্রতিবেদন।

                                        বাংলাদেশে রূপপূর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

আপনারা সবাই জানেন বাংলাদেশ সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের জন্য রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে। ঢাকা থেকে ১৮০ কি মি দুরে পাবনার, রূপপুরে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র টি হবে। প্রস্তাবিত চুক্তিতে ১৫০০০ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের কথা রয়েছে। নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পরিকল্পনা করা হয় সেই পাকিস্তান আমলে, ১৯৬১ সালের দিকে।সেই সময়কার সরকার বেশ কিছু পর্যালোচনার ভিত্তিতে পাবনার রূপপুরে ৭০ মেগাওয়াটের একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু কোন অজানা কারণে তা আর বাস্তবায়িত হয় নি। ২০০৯ সাল থেকেই পত্রপত্রিকা মারফত আমরা খবর পেয়ে আসছি যে এই সরকার রাশিয়ার
সঙ্গে নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের
লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক বা MOU (Memorendum of Understanding) স্বাক্ষর করেছে। অবশেষে আমরা সত্যি সত্যি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধিকারী হতে যাচ্ছি। নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের দেশের জন্য আশির্বাদ।অবশ্য ১টি জাতির জন্য সম্মানের বটে। বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় ব্যাপক বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। তাই আমাদের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমধান প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী সমধান হিসাবে সরকার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কেননা এরকম একটি প্লেন্টের আয়ুষ্কাল ৩৫ বছর।অর্থ্যাৎ ৩৫ বছর আমাদের বিদ্যুৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এখন অবশ্য অনেকে বলবেন এটি আমাদের জন্য অনেক সুফল বয়ে আনবে।লোডশেডিং থাকবে না। নিঃসন্দেহ বলা যায় বাংলাদেশ পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছে। এটি বাংলাদেশে কে সামনে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে।বাংলাদেশ পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করাতে আমি নিজেও সাধুবাদ জানাই।কিন্তু আমরা যদি সুদুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমাদের জন্য অভিশাপ। আমাদের দেশের খুব কম মানুষই জানে যে পারমাণবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটলে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কারণে কী মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। আলোচনা করার আগে দেখে আসি কয়েকটি পারমাণবিক দুর্ঘটনা।
ফুকুসিমা :- জাপানের এই দুর্ঘটনাটি একেবারেই প্রাকৃতিক,
এখনো পর্যন্ত কারো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা বা ডিজাইনের ত্রুটিকে দায়ী করার মতো আলামত পাওয়া যায়নি। ভুমিকম্প ও সুনামীর আঘাতে এই আণবিক শক্তি কেন্দ্রের একটি আনবিক চুল্লি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং চুল্লির অভ্যন্তরভাগকে নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় রাখার জন্য যে ঠান্ডাকরণ ব্যবস্থা তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ফলে ১টি বড় ধরনের হাইড্রোজেন বিস্ফোরন হয়। ইতিমধ্যে জাপান সরকার কেন্দ্রের ২০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা সব মানুষকে সরিয়ে নেয়েছে।
চেরনোবিল :- ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল স্থানীয় সময় রাত ১টা ২৩ মিনিটে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত চেরনোবিল পারমাণবিক স্থাপনার চতুর্থ চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটে। এ পারমাণবিক দুর্ঘটনাকে এ পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো
প্রধানত এর চালকদের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, কিছু ডিজাইন ক্রুটি ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশনের
অভাবে (অতিরিক্ত গোপনীয়তা)।
চেরনোবিল দুর্ঘটনায় তাৎক্ষনিক ও কিছু দিনের মধ্যে মারা পড়েন প্রায় দশ হাজার মানুষ, লাখে লাখে মানুষ ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, শিশুরা ব্যাপকহারে লিউকেমিয়ার
শিকার, বিকলাঙ্গ ও বিভিন্ন আরোগ্যহীন ব্যাধি নিয়ে এখনো জন্ম নিচ্ছে শিশুরা, গোটা একটি নগরী চিরদিনের মতো পরিত্যাক্ত ঘোষণা
করা হয়েছে।
থ্রী-মাইলস আইল্যান্ড :- আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের থ্রী- মাইলস আইল্যান্ডে ১৯৭৯ সনে প্রায় চেরনোবিলের মতোই আংশিক মেল্ট-ডাউন হয়, প্রাণহানী এড়ানো গেলেও প্রচুর মানুষ
উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় বিকিরণের শিকার হয়ে পরবর্তিতে ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়, যার হিসাবও এমনকি ঠিকভাবে করতে
পারেনি কর্তৃপক্ষগুলো। তাৎক্ষণিক ৫ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নিতে হয়।
এবার আমরা বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করি। আশা করা যায় বাংলাদেশে ২০১৭/১৮ সালের মধ্যে রূপপুরে একটি ১ হাজার মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ হয়ে যাবে।বাকিটা হবে ২০২২ সালের মধ্যে। বাংলাদেশের আয়তন হিসাবে জনসংখ্যা বেশি। রাশিয়ার পক্ষ
থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের রূপপুরে যে ভিভিইআর-১০০০ চুল্লিটি বসানো হবে তা তৃতীয় জেনারেশনের এবং ইতিপূর্বে রাশিয়ায় ব্যবহূত জইগক চুল্লি থেকে ভিন্ন ও উন্নত। এতে সর্বাধুনিক
প্রযুক্তি অনুসরণ করা হবে। আমরা যতদূর জানি ROSATOM কর্তৃক প্রয়োগকৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তি
হচ্ছে VVER-1000 যা আসলে Pressurized Water Reactor (PWR) এর একটি আধুনিক রূপ। ROSATOM-এর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে এই প্রযুক্তিতে কোন ধরনের দূর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই, এটি ১০ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ভারী যাত্রীবাহি বিমানের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা
রাখে। কিন্তু তাদের এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। কারন বিখ্যাত পরিবেশবাদী সংগঠন GREENPEACE তাদের প্রকাশনায় vver-1000 সিরিজের
নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট-এর বেশ কিছু কারিগিরি ত্রুটির কথ উল্লেখ করেছে এবং এই ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারী যাত্রীবাহি বিমানের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। তবুও আমার মনে কিছু প্রশ্ন থেকে গেছে।
নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উপজাত হিসেবে যে বর্জ্য তৈরী হয় সেগুলো তেজস্ক্রিয় এবং এর তেজস্ক্রিয়তা কমে সহনীয় পর্যায়ে
আসতে কমপক্ষে ২৪,০০০ বছর(!) লাগবে। তার মানে নিউক্লিয়ার বর্জ্যকে সরিয়ে আমাদের এমন কোথাও রাখতে হবে যা ঝুঁকিহীন থাকবে টানা
চব্বিশ হাজার বছর। প্রতিটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গড়ে প্রতি বছরে ২০-৩০ টন উচ্চমাত্রার পারমানবিক বর্জ্য নির্গত হয়। এই পারমানবিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এর আয়ুস্কাল অত্যন্ত বেশি। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত অতি উচ্চমাত্রার তেজষ্ক্রিয় পদার্থের মধ্যে রয়েছে Technetium-99 (হাফ লাইফ ২২০০০০ বছর), iodine-129(হাফ লাইফ ১৫.৭ মিলিয়ন বছর), Neptunium-237(হাফ লাইফ ২ মিলিয়ন বছর), Plutonium-239(হাফ লাইফ২৪০০০ বছর)। সবচেয়ে আশংকার কথা এটাই যে এই পারমানবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঠিক উপায় এখনও আবিষ্কার করা যায়নি। অতএব এই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঝুঁকিটা কেবল আমাদেরই থাকছে না, ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে আমাদেও পরবর্তী প্রজন্মগুলোর জন্যও। যদিও
সংবাদে ‘রাশিয়া নিজেই সেই পারমাণবিক বর্জ্য হিসেবে চিহ্ণিত ব্যবহ্রত জ্বালানি ফেরত নেবে’ এইরকম একটি ধারা বাংলাদেশ প্রস্তাবিত খসড়া চুক্তিতে থাকলেও সেটি তারা
কিভাবে করবে, তার জন্য খরচাপাতি কেমন, বর্জ্য পরিবহন এবং স্থানান্তরের ঝুকি কার ইত্যাদির কোন উল্লেখ আমরা কোথাও পাই না।
আমরা কি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর মতো দক্ষ
হয়েছি? যেখানে আমাদের
তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অনেকগুলোর মূল নিয়ন্ত্রন চীনা প্রকৌশলীদের হাতে থাকে, এখানেও নিশ্চিতভাবে তা থাকবে রাশান প্রকৌশলীদের হাতে। কিন্তু এরা কি সেই একই প্রকৌশলীরা নয় যারা পৃথিবীর ভয়াবহতম দশটি পারমাণবিক দুর্ঘটনার ৪টি ঘটিয়েছে? এদের রেকর্ড পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। তারচেয়েও বড় কথা প্রকৌশলীই শেষ
কথা নয়, একটি দেশের সাপোর্ট-ইনফ্রাস্ট্রাকচার হলো বড় কথা, একটি আণবিক জরুরী পরিস্থিতি উপস্থিত হলে তাকে মোকাবেলার মতো দক্ষ
লোকবল ও অন্যান্য সুযোগ কি বাংলাদেশের আছে? যেই দেশে রেললাইনের উপর বাস উঠে পড়ে
ট্রেন যাবার ১৫ সেকেন্ড আগে, যেই দেশে প্রতিদিন বাস-বা ট্রাক চাপা দিয়ে যায় কোন না কোন নিরীহ প্রাণ, সেই দেশে পারমাণবিক কেন্দ্রকে দায়িত্বশীলরা একটু বেশি মনোযোগ
দিলেও একটা না একটা সময় দায়িত্ব পালনে ঢিলেমি দেবেই, এবং সেদিনই জন্ম হতে পারে পৃথিবীর ভয়াবহতম পারমাণবিক দুর্ঘটনার।
এটা সত্য বাংলাদেশ দূর্যোগের দেশ, অত্যন্ত সফলভাবে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিও আকর্ষন করেছি। কিন্তু সাইক্লোন আর পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনাকে এক করে দেখার বোধ হয় কোনই সুযোগ নেই।আমি যতটুকু জানি পদ্মার তীরবর্তী রূপপুর ভূ -স্থর পলিগঠিত নমনীয় মাটির। এই ধরনের এলাকায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারটা কতটা ঝুঁকিমুক্ত, সেটাও দেখতে হবে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মহল থেকে জানা গেছে, রূপপুর ভূ-চ্যুতির
ওপর অবস্থিত। এ ধরনের ভূচ্যুতি ভূমিকম্পের উৎসস্থল হয়। কাজেই জায়গাটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সাইক্লোন ও বন্যা দুটোই যথেষ্ঠ প্রস্তুতির সময় দিয়ে আসে, ভুমিকম্প আসে কোন নোটিস ছাড়া, সুনামী আসে কিছু মিনিট থেকে কয়েকঘন্টার নোটিসে। সাইক্লোনে মানুষ সরাবার জন্য সময় পাওয়া যায়
প্রায় ২ দিন, দূরে কোথাও সরাতে হয়না, একই এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে তুলে দিতে পারলেই নিরাপদ। কিন্তু পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে
হয়তো সময় পাওয়া যাবে মাত্র কয়েকঘন্টা, লাখ লাখ লোক সরিয়ে নিতে হবে অনেক দূরের কোন
এলাকায়, এবং দুর্ঘটনা ঘটে যাবার অন্তত ৫০ বছরের মধ্যে সেখানে তারা আর কোনদিন ফিরতে পারবে না। ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য ৫০/৬০
বছর পরিত্যাক্ত ফেলে রাখার মতো কি সামর্থ্য আমাদের রয়েছে? কয়েকঘন্টার মধ্যে ৩ লাখ লোক সরাবার মতো
দক্ষতা কি গোটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও আছে? বাস্তব সত্য হলো, হুড়োহুড়িতে যে ট্রাফিক
জ্যাম হবে তাই সরাবার মতো সড়কব্যবস্থা ও দক্ষতা বাংলাদেশের নেই।
চেরনোবিলের ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন স্বাভাবিক লোকবসতি ছিলোনা, তারপরও প্রাণহানী হয়েছে দশ হাজার, রোগাক্রান্ত লাখ লাখ। আমাদের দেশে এমন একটিও কি স্থান আছে যার ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে বসতি নেই? রূপপুরের ৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কত লোক বাস করে একটু সময় নিলে একটা হিসাব বের
করতে পারবো, তবে সময় না নিয়েও আন্দাজ করতে পারি তিন লাখের কম নয় (বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১০০ মানুষ বাস করে)। চেরনোবিল বা থ্রী-মাইলসের মতো মেল্ট-ডাউন ঘটলে ২/৩ দিনেই মানুষ মারা পড়তে পারে একলাখ, পরবর্তী ১০ বছরে ধুঁকে ধুঁকে মারা যেতে
পারে আরো দশলাখ, পরবর্তী ২০/৩০ বছরে বিকলাঙ্গ ও রোগাক্রান্ত শিশুর জন্ম হতে পারে আরো দশ-বিশ লাখ? তা-ও মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য? আর ততদিনে ১৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ উঠে আসবে তো?
খরচ:- সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের
দায়িত্ব যে সংস্থাকে দেয়া হয়েছে সেই
ROSATOM খোদ রাশিয়ার বুকে একই ধরনের (VVER-1000) বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানে অনেক বেশি সময় এবং খরচ নিচ্ছে। রাশিয়ার পরিবেশবাদী সংগঠন ECO DEFENCEএর Co-Chairman Vladimir Slivyak-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ি রাশিয়ার মাটিতে এক একটি VVER-1000 সিরিজের বিদ্যুৎ কেন্দ্র
বসাতে খরচ পড়ে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বাংলাদেশে বসাতে গেলে তা নূ্ন্যতম ১.৫ বিলিয়ন ডলারের-৪ গুন বেশি খরচ পড়বে। সেই হিসেবে আমাদের প্রতিটি ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মান খরচ পড়বে কম্পক্ষে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার(১.৫ গুন ধরলে) বা ৩৩ হাজার
কোটি টাকা অর্থাৎ ১০০০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করতেই খরচ পড়বে প্রায় ৬৬ হাজার কোটি টাকা। যেখানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ৫ টি ৫০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের খরচ ধরা হয়েছে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ আমরা দেখলাম রূপপূর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মান খরচ ধরা হয়েছে মাত্র(!) ১.৫-২ বিলিয়ন
ডলার। এটা কিসের ভিত্তিতে এবং এতে কোন কোন ব্যয় অর্ন্তভুক্ত তা কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। অথচ জনমনে এমন একটা ধারনা দেয়া হচ্ছে যেন
এই ১.৫-২ বিলিয়ন ডলার খরচ করলেই আমরা উৎপাদনে যেতে পারব।
তাছাড়া আমার আরেকটি বিষয় নিয়ে সন্দেহ রয়েছ, আশা প্রকাশ করা হয়েছে রূপপূর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ২০১৭-২০১৮ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। অথচ যখন আমরা দেখি
একই ধরনের রিয়েক্টর রাশিয়ার মাটিতে বসাতেই কমপক্ষে ৯ বছর সময় লাগে। এক্ষেত্রে সকল ডকুমেন্টেশন এবং লাইসেন্সিং-এর কাজ সম্পন্ন করা ছিল(যা করতে কমপক্ষে ২বছর সময় লাগে)। তাই এই আশাবাদের ভিত্তি কি তা যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেগ করে।
কিক স্টাডি থেকে জানা যায় নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৫ কিমি ব্যাসার্ধের মাঝে বসবাসকারী শিশুদের
লিউকেমিয়ায় বা কান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তার বাইরে বসবাসকারী শিশুদের তুলনায় অন্ততপক্ষে দ্বিগুণ। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়
নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের আশেপাশে অবস্থিত লোকালয়গুলিতে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি লক্ষে ২৬-২৮ জন যেখানে গড়পড়তা স্তন ক্যান্সারজনিত মৃত্যুহার হচ্ছে
প্রতি লক্ষে ২০-২২ জন। এই গবেষণাটি হয়েছে যুক্তরাষ্টে যারা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।অথচ আমাদের দেশে ১ কি মি ভিতরে লোক বসবাস করে।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে,উপরে আলোচিত পারমাণবিক দুর্ঘটনা গুলো যেসব দেশে হয়েছে,তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী। পারমাণবিক দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠার মত অর্থনৈতিক শক্তি তাদের রয়েছে। বাংলাদেশ কি তা কাটিয়ে উঠতে পারবে?। যদি বাংলাদেশে এরকম দুর্ঘটনা হয়,তা হবে ভয়াবহ। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘন-বসতিপূর্ণ দেশ।মৃত্যুর হার হবে অন্য দুর্ঘটনা গুলো থেকে বেশি।তাছাড়া বাংলাদেশে যদি এই রকম দুর্ঘটনা ঘটে কমপক্ষে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হবে।ফুকুসিমা দূর্ঘটনার পর জাপানে আজ প্রতি বাড়িতে রেডিয়েশন মাপার জন্য ডেকো মিটার রাখা হয়। অথচ আমাদের দেশে জ্বর মাপার জন্য প্রতি বাড়িতে থার্মোমিটার নেই।
-আধুনিক সমরাস্ত্র অবলম্বনে সোহেল আদনান।

Powered by Blogger.