কী ঘটতে পারে, যদি কোনও মানুষ একটানা একমাস জেগে থাকে!
মানবশরীরের সুস্থতার জন্য নিয়মিত এবং
পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কী ঘটতে
পারে, যদি কোনও মানুষ একটানা একমাস
জেগে থাকে! সেটাই জানার জন্য এক
সময়ে এক উদ্ভট পরীক্ষা চালিয়েছিলেন
একদল বিজ্ঞানী। সেই পরীক্ষার পরিণাম
যা হয়, তা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।
ঘটনাস্থল ১৯৪০ সালের রাশিয়া। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ তখন চলছে পুরোদমে। সেই সময়েই
দেশের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ৫ বন্দির
উপরে এক অদ্ভুত পরীক্ষা চালান রাশিয়ার
বিজ্ঞানীরা। তাঁদের লক্ষ্য ছিল এমন
একটি গ্যাস আবিষ্কার করা, যা মানুষের
শরীর থেকে ঘুমের প্রয়োজনকে দূরীভূত
করবে। প্রাথমিকভাবে যে গ্যাসটি তাঁরা
তৈরি করেন, তার সাফল্য কতখানি তা
পরীক্ষা করার ‘গিনিপিগ’ হিসেবে তাঁরা
বেছে নেন ওই ৫ বন্দিকে। একটি প্রায়
বায়ুরুদ্ধ ঘরের ভিতরে তাদের ঢুকিয়ে
দেওয়া হয়। বন্দিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ
সংস্পর্শে যাতে বিজ্ঞানী বা রক্ষীদের
আসতে না হয়, সেইজন্য ঘরের সঙ্গে
বাইরের যোগাযোগের জন্য রেখে দেওয়া
হয় মাইক্রোফোন। এছাড়া, জেলের ভিতরে
নিয়মিত খাবার দেওয়া, ও টয়লেটের
বন্দোবস্তও রাখা হয়। তারপর ধীরে ধীরে
সেই ঘুমরোধী গ্যাস প্রবিষ্ট করানো শুরু হয়
সেই ঘরের ভিতর। বিজ্ঞানীদের
পরিকল্পনা ছিল এক মাসের জন্য সেই
মানুষগুলিকে বন্দি রেখে পরীক্ষাটি
চালানোর। বন্দিদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া
হয়েছিল, তারা যদি তিরিশ দিন
নিরুপদ্রবভাবে তাদের বন্দিদশা মেনে
নেয়, তাহলে তিরিশ দিন পরে তাদের
মুক্তি দেওয়া হবে। প্রথম দিন তিনেক সব
ঠিকঠাক চলল। পাঁচ দিনের পর থেকে
মাইক্রোফোনে শোনা গেল, বন্দিরা
তাদের অতীত জীবনে কৃত নানা অপরাধের
কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু
করেছে। তারপর শুরু হল তাদের প্রলাপ বকা,
এবং কোন কাজের জন্য আজ তাদের এই
বন্দিদশা— সেই নিয়ে অনুশোচনা। দিন
দশেকের পর থেকে বন্দিদের আচার-
আচরণে ক্রমশ উন্মাদনার লক্ষণ প্রকাশ
পেতে থাকে। এক বন্দি একদিন একটানা
তিন ঘন্টা তারস্বরে চিৎকার করে যায়।
বিজ্ঞানী ও কারারক্ষীরা
মাইক্রোফোনে শুনতে পান সেই চিৎকার।
তারপর আস্তে আস্তে সব শান্ত হয়ে
আসতে থাকে। ১৪ নম্বর দিনে
বিজ্ঞানীরা কৌতূহলী হয়ে ইন্টারকমে
যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন বন্দিদের
সঙ্গে। বন্দিদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়
যে, যদি তারা এই পরীক্ষায় সহযোগিতা
করে তাহলে তিরিশ দিনের মাথায়
মিলবে মুক্তি। বন্দিদের তরফ থেকে
মাইক্রোফোনে উত্তর ভেসে আসে— ‘‘কে
চায় মু্ক্তি?’’ বন্দিদের এই অস্বাভাবিক
আচরণে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা পনেরো
নম্বর দিনে গ্যাসের প্রয়োগ বন্ধ করার
সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য, গ্যাস
বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্দিরা কাকুতি-
মিনতি শুরু করে গ্যাস পুনরায় চালু করার
জন্য! কারারক্ষীদের পাঠানো হয়
বন্দিদের জেল থেকে বের করে আনার
জন্য। জেলের দরজা খুলে চোখ কপালে ওঠে
রক্ষীদের। তাঁরা দেখেন, জেলের ভিতর
জীবন্ত রয়েছে মাত্র চারজন বন্দি। আর এক
বন্দির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে মাটিতে।
বন্দিদের জন্য দেওয়া খাবারও অভুক্ত
অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু মৃতদেহটির
শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে কারা যেন
খুবলে খেয়েছে মাংস। এমনকী জীবন্ত চার
বন্দির দেহ থেকেও মাংস খুবলে খাওয়ার
চিহ্ন। বুঝতে বাকি থাকে না যে, বন্দিরা
স্বাভাবিক খাবার বাদ দিয়ে একে অন্যকে
খাওয়া শুরু করেছে। এই দৃশ্য দেখে সন্ত্রস্ত
রক্ষীরা বন্দিদের জেল থেকে বার করে
নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হিংস্রভাবে
তারা বাধা দেয়। রক্ষীদের সঙ্গে তাদের
ধস্তাধস্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে,
রক্ষীরা শেষ পর্যন্ত গুলি চালাতে বাধ্য
হন। তিন জন বন্দি গুলি লেগে মারা যায়।
জীবিত চতুর্থ বন্দিটি রক্ষীদের দিকে
তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি হেসে বলে,
‘‘তোমরা কি ভুলে গিয়েছ, যে আমরাই
তোমরা?’’ এই কথা শুনে গুলি চালিয়ে দেন
রক্ষীরা। মারা যাওয়ার আগে সেই বন্দি
বলে, ‘‘মুক্তির এত কাছে পৌঁছেও...।’’
নিজের কথা আর শেষ করতে পারেনি সে।
ঘুমের অভাব যে মানুষের শরীর ও মনের উপর
কী মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, তার
এক চরম নিদর্শন হয়ে রয়েছে রাশিয়ান
বিজ্ঞানীদের এই পরীক্ষা।