বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প ঐতিহ্য বর্তমান ও সম্ভাবনা

কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড লিমিটেড

ছোটবেলা থেকে আমাদের পাঠ্যবইয়ের একটি অতি পরিচিত বাক্য- " বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ "।বাস্তবেই প্রতিবেশীর শোষণের ফলে অনেক নদ-নদী হারিয়ে গেলেও এখনো প্রায় ৭০০ নদ-নদী আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়।কেউ হয়তো ধুঁকতে-ধুঁকতে,কেউ আবার পূর্ণোদ্যমে ঢেউয়ের গর্জন তুলে।

নদীপথের বিস্তৃতির কারণেই বাংলাদেশে প্রাচীন আমল থেকেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিস্তার ঘটেছে।উসমানী খেলাফত আমলে আমাদের বাংলার প্রাচীন শিপইয়ার্ড গুলো থেকে উসমানী নৌবাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ কিনে নেওয়া হতো।যা পরবর্তীতে দিগন্ত বিস্তৃত সাগর-মহাসাগরে রোমান-ইউরোপিয়ান নৌবাহিনীর সাথে টক্কর দিয়ে বিজয় নিশান উড়িয়ে ফেরত আসতো।আর এইকথা স্বীকৃত যে,ইউরোপীয় জাহাজগুলোর তুলনায় বাংলার সেসময়কার শিপইয়ার্ডে তৈরী জাহাজগুলো তুলনামূলকভাবে দারুণ মজবুত আর আধুনিক ছিলো।সেসব লেখা এই পোস্টে সম্ভব নয়।পরবর্তীতে হয়তো লেখা হবে।

বর্তমান বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ অথবা জাহাজ ভাঙা দুটো শিল্পই দারুণ বিস্তার লাভ করেছে।ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগন্জ থেকে খুলনা পর্যন্ত শিপইয়ার্ড এর সংখ্যাটি আমাদের ২০০!এর মধ্যে আছে ওয়েস্টার্ন মেরিন-আনন্দ এর মতো শিপইয়ার্ড লিমিটেড।আছে খুলনা শিপইয়ার্ড ও চট্রগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেড এর মতো জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও।

বাংলাদেশের ভারী শিল্পের ভেতর জাহাজনির্মাণ শিল্প অন্যতম,যারা বেশ আগে থেকেই রপ্তানিকারকের তালিকায় যোগ হয়েছে।বিগত দশ বছরে এই খাত থেকে আমাদের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।এই সময়ের মধ্যে আমাদের রপ্তানিকৃত জাহাজের সংখ্যা ৪০+ টি।এই ক্ষেত্রে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের অবদান সবচেয়ে বেশি।এই বছরেরই জানুয়ারি মাসের একটি রিপোর্টে বলা হয়,এই খাতের রপ্তানি আয়ের ৮৯% অংশ ওয়েস্টার্ন মেরিনের।

এই খাতে আমাদের কাছাকাছি বড় মাপের কোনো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা ও কম।নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন,কারণটা কি?
বড় মাপের জাহাজ নির্মাতা হিসাবে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান আমাদের এই অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাঁড়াতে পারতো তার মধ্যে ছিলো সাউথ কোরিয়ান Daewoo (উলসান ক্লাসের নির্মাতা) এবং Samsung এর মতো বড় প্রতিষ্ঠান।নিশ্চয়ই তখন আমাদের টিকে থাকার জন্য তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হতো।কিন্তু,আমাদের তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার প্রয়োজন নেই।কারণ এসমস্ত হেভি ভেসেল নির্মাতাদের বিপরীতে আমরা নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছি ছোট থেকে মাঝারি আকারের সমুদ্রগামী জাহাজকে।দক্ষিণ কোরিয়ান-জাপানি জাহাজ নির্মাতারা যেখানে ৫০০০০+ DWT ( Dead Weight Tonnage) এর ভারী জাহাজ নির্মাণ করছে,সেখানে আমরা মনোযোগ দিয়েছি ১২০০০ DWT এর কম ওজনের জাহাজ তৈরীতে।ফলে আমাদের শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রির জায়ান্টদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার প্রয়োজন হচ্ছে না।

বাংলাদেশ যদি এই শিল্পকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়,ধারণা করা হচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে এই সেক্টর থেকে আমরা কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হব।এবং যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি করা হয়,তাহলে বাংলাদেশ এইক্ষেত্রে বিশ্বের ছোট ও মিডিয়াম ভেসেল নির্মাতাদের জন্য একটি আন-এক্সপেক্টেড কম্পিটিটর হিসাবে আবির্ভূত হতে চলেছে।

বাংলাদেশি শিপইয়ার্ড সমূহের হাতে বর্তমানে বড় সংখ্যায় জলযান নির্মাণের অর্ডার রয়েছে।যার অধিকাংশই দেশীয় সংস্থা সমূহের।এছাড়াও বড় একটা সংখ্যায় বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশের শিপইয়ার্ড গুলোর সাথে জাহাজ ক্রয়ের চুক্তি সম্পন্ন করেছে।বিগত ১০ বছরে রপ্তানিকৃত জাহাজসমূহ যাদের হাতে গিয়েছে,তাদের মধ্যে রয়েছে- নিউজিল্যান্ড,জার্মানি ও পাকিস্তান সহ মোজাম্বিক ও জাম্বিয়ার মতো আফ্রিকান দেশ ও।বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কিছু কারণের মধ্যে আছে জাহাজ থেকে সাগরের জলরাশিতে তেল মিশে যাওয়া।এই বিষয়ে কনসার্নড জাহাজক্রেতারা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং নতুন ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করে এমন জাহাজের দিকে ঝুকছেন।আশার কথা,বাংলাদেশ ও এদিকে নজর দিয়েছে।লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস তথা এলএনজিকে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে এমন একটি জাহাজের অর্ডার আমাদের দেশের শিপইয়ার্ডের হাতে রয়েছে।যা বাইরের কোনো দেশ হতে করা হয়েছে।

ধারণা করা হয়ে থাকে,২০২৬ নাগাদ পুরো পৃথিবীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের আয়ের পরিমাণ হবে ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।আমরা কিন্তু চাইলেই এই বিশাল অংকের একটি বড় অংশ হয়ে উঠতে পারি।যেখানে ভারী এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতে অনেক বছর যাবতই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল্লাহিল বারী এর মতে- "সরকার এই খাতে দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ-সুবিধা দিলে বাংলাদেশ এই শিল্পের ক্ষেত্রে কয়েক বছরের ভেতরেই বিশ্ববাজারের একটি বড় অংশের দখল নিতে সক্ষম।"

বর্তমানে এই শিল্পে ৩০০০০+ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
শীর্ষস্থানীয় জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিনের চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেন- এই সংখ্যা পরবর্তী ৫ বছরে ৫০০০০+ এ উন্নীত হবে এবং ১৫ বছরের মধ্যে ১০০০০০+ ( এক লক্ষ) এ উন্নীত হবে।

জাহাজ নির্মাণ শিল্প অনেক আগে থেকেই এশিয়ার ছিলো,পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়ানদের হাতে চলে যায়।তারা একটা সময়ে সর্বশক্তিতে বাধা দিয়েছে,যেন পরবর্তীতে এই মহাদেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প শক্তিশালী না থাকে।যদিও,বাংলার তৈরী জাহাজ নিয়েই লর্ড নেলসন ব্যাটল অব ট্রাফালগারে নেপোলিয়নের নৌবহরকে পরাভূত করেন।

বর্তমানে এই শিল্প আবার ও অামাদের হয়েছে।যদিও মূলত এই খাতের বড় আকারের জাহাজ সমূহের বাজার এখন দক্ষিণ কোরিয়ান-জাপানিজ-চায়নিজদের দখলে।কিন্তু,উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারো আমাদের জাহাজশিল্প প্রাচীন কালের মতোই দাপুটে ভূমিকায় উঠে দাড়াবে ইনশাআল্লাহ।

বর্তমানে আমাদের শিপইয়ার্ড সমূহে নির্মিত জাহাজ সমূহের মধ্যে রয়েছে -

বেসামরিক- কনটেইনার-কার্গো ভেসেল ও টূরিস্ট্য শিপ সহ টাগ-ফেরি বোট ইত্যাদি।
সামরিক - অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার ভেসেল।লার্জ প্যাট্রল ক্রাফট,ল্যান্ডিং ক্রাফট ( শক্তিমান) ইত্যাদি।এছাড়াও আমরা অতিশীঘ্রই ভারী ফ্রিগেট শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ তৈরীর কাজে হাত দিবো ইনশাআল্লাহ।

তথ‌্যসূত্রঃ ঢাকা ট্রিবিউন, লাইট ক‌্যাস্টেলবিডি ও লেখা আধুনিক সমরাস্ত্র অবলম্বনে।

নিয়মিত রোমাঞ্চকর সামরিক বিষয়ক পোষ্ট পেতে লাইক দিন আমাদের ফেইসবুক ফ‌্যান পেইজে- Click here



Powered by Blogger.