ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-১)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৌযুদ্ধগুলো ছিলো অনেক ভয়ংকর। শক্তিশালী জাপানিজ ইম্পেরিয়াল নেভি ও মার্কিন নেভির মধ্যে কামান দাগানোর অনেক ঘটনা ঘটেছে। 'ব্যাটল অফ মিডওয়ে' নামে আজকে যে নৌযুদ্ধের কথা বলা হবে তা তীব্রতার হিসেবে বেশিরভাগ গবেষকের মতে দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। তবে কেউ কেউ একে প্রথম স্থানেও রাখেন। এই যুদ্ধে জাপানের নৌবাহিনীর পরাজয়ের ফলে তাদের যে ক্ষতি হয় সেটা তারা আর কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং যুদ্ধে জাপানের চূড়ান্ত পরাজয়ের পেছনে ব্যাটল অফ মিডওয়ের অনেকটাই ভূমিকা আছে!
☆ ব্যাটল অফ মিডওয়ে প্রেক্ষাপট:
১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে জাপানের আক্রমণের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। পার্ল হারবারে আক্রমণের ৬ মাস পরে জাপানি অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপের মার্কিন নৌবাহিনীর প্রধান নৌঘাঁটিতে পার্ল হারবার স্টাইলে আবারও আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জাপান আর্মি চেয়েছিল নৌবাহিনী এবার প্যাসিফিক ক্যাম্পেইনে অন্য অঞ্চলগুলো দখল করার জন্য সেনা পাঠানোর অপারেশনে যেন সাহায্য করে। কিন্তু ইয়ামামোতো পার্ল হারবারে মার্কিন ব্যাটলশিপ ফোর্সের ৮টি জাহাজ ডুবিয়ে/ক্ষতিগ্রস্ত করেও শান্তি পাচ্ছিলেন না। কেননা পরিকল্পনা মোতাবেক ফ্লিট ক্যারিয়ারগুলোকে পার্ল হারবারে পাওয়া যায়নি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেখানে থাকা আমেরিকান ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপগুলোসহ অন্য যুদ্ধজাহাজগুলো ধ্বংস করা। কারণ এই ঘাঁটি ব্যবহার করে প্রায়ই জাপান অধিকৃত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বোমা হামলা চালাতো। মিডওয়েতে হামলার কিছুদিন আগে ১৮ এপ্রিল, ১৯৪২ সালে ইউএসএস হর্নেট নামের একটি মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার জাপানি উপকূলে গিয়ে ১৬টি হেভি বোম্বার বিমান লঞ্চ করে। ইতিহাসে The Doolittle Raid নামে বিখ্যাত এই 'হিট এন্ড রান' অপারেশনে জাপানের রাজধানী টোকিও ও আশেপাশের এলাকায় অতর্কিতভাবে হামলা করে দ্রুত পালিয়ে গিয়েছিল। প্রায় অরক্ষিতভাবে সাপোর্টিং যুদ্ধজাহাজ ছাড়া এভাবে শুধুমাত্র এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দিয়ে হামলার ঘটনা একদমই বিরল ঘটনা। মূলত এ ঘটনার পর পরই ইয়ামামোতোর থিওরিতে জাপানি নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে 'মার্কিন ক্যারিয়ারগুলো জাপানের জন্য এখন বিরাট হুমকি'। এমনকি জাপানি মূলভূমিও এখন আর নিরাপদ নয়। ফলে ইয়ামামোতোর অপারেশন পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
কিন্তু পার্ল হারবারের মতো এবার হাওয়াই দ্বীপের নৌঘাঁটিতে হামলার পরিকল্পনা একেবারে আত্মহত্যার শামিল। যুক্তরাষ্ট্র এবার দ্বিগুণ সতর্ক তো বটেই, তারা এবার পার্ল হারবারের ১৮টি যুদ্ধজাহাজ হারানোর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আরো যুদ্ধজাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এনে এখানে মোতায়েন করেছে। এছাড়া সাগরে সর্বদা ঘুরে বেড়ানো মার্কিন সাবমেরিন ফ্লিট ও হাওয়াই, হনলুলু, গুয়াম ইত্যাদি দ্বীপের লংরেঞ্জ পেট্রোল বিমানগুলোর নজর এড়িয়ে হামলা করা একেবারেই অসম্ভব। তাই ফাঁদ পেতে মূল ঘাঁটি থেকে মার্কিন ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রূপকে বের করে এনে হামলার পরিকল্পনা করেন এডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতো।
এজন্য তিনি মিডওয়ে আইল্যান্ডকে বেছে নেন। এটি হাওয়াইয়ান আইল্যান্ড থেকে ১,৩০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই এখানে একটি সাবমেরিন রিফুয়েলিং বেজ স্থাপন করেছিল যার সাহায্যে ১,২০০ মাইল এলাকায় নিয়মিত টহল দিত মার্কিন সাবমেরিন বহর। এছাড়া এখানে সি-প্লেন ও লংরেঞ্জ B-17 বোমারু বিমানের ঘাঁটি বানানো হয়েছিল যার সাহায্যে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপান অধিকৃত দ্বীপগুলোর উপর নিয়মিত হামলা করা হতো সবচেয়ে বড় কথা ছিল জাপানি বাণিজ্যিক জাহাজগুলো প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছিলো মার্কিন সাবমেরিনের হাতে। দ্বীপরাষ্ট্র জাপান এ কারণে বেশ সমস্যায় পড়ে যায়। তাই মার্কিনীদের পাল্টা জবাব দিতে ও ক্যারিয়ার ফ্লিটকে অ্যাম্বুশের সময় মিডওয়ে থেকে তেমন বড় ধরনের সাপোর্ট আসবে না (বোমারু বিমানগুলো যুদ্ধজাহাজে হামলার উপযোগী নয়) জেনে এই অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয় জাপানী হাই-কমান্ড।
☆ মার্কিনীদের গুটিবাজি:
পার্ল হারবার আক্রমণের পর মার্কিন নেভাল ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করা হয়। যার ফলে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের প্রস্তুতি খোলাখুলিভাবে নিলেও হাওয়াই দ্বীপে আক্রমণের প্রস্তুতি অনেক গোপনীয়তার সাথে নিয়েছিল। কিন্তু এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই আক্রমণের কথা গোয়েন্দাদের মাধ্যমে জানতে পেরে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেয়। মূলত ক্যাপ্টেন জোসেফের নেতৃত্বে থাকা মার্কিন ক্রিপ্টোগ্রাফারগণ জাপানীদের নেভাল কমিউনেকেশন কোড ভেঙে ফেলতে সক্ষম হন। ফলে অনেক গোপন মেসেজের অর্থ জানা সম্ভব হয়।
এপ্রিলের ঐ হামলার পর পরই প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষত মিডওয়ে অঞ্চলের বিভিন্ন কমান্ডারের সাথে অ্যাডমিরাল ইয়ামামোতোর রেডিও যোগাযোগ বেড়ে যায়। ফলে মার্কিনীদের সন্দেহ হয় যে জাপানিরা মিডওয়েকে ঘিরে বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা করছে। ব্যাপারটি নিশ্চিত হতে তারা কিছু ভুয়া তথ্য রেডিওতে ছড়ায়। যেমন- মিডওয়ে দ্বীপে বেশ বড়সড় এয়ারফিল্ড রয়েছে। একে জাপানিরা AF দ্বারা রেডিওতে চিহ্নিত করতো। AF যে Air field বোঝায় সেটা তো সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, পুরো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অসংখ্য দ্বীপে মার্কিন এয়ারফিল্ড ছিল। তাই প্রকৃত টার্গেট কোনটি সেটি বোঝা যায়নি। এসময় তারা ভুয়া নিউজ ছড়ায় যে মিডওয়ের পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টে সমস্যা দেখা দিয়েছে। জাপানিরা মার্কিন রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠায় যে 'AF এর পানি বিশুদ্ধকরণ প্ল্যান্টে সমস্যা'। ব্যস! আর যায় কোথায়। আক্রমণ যে মিডওয়েতে হবে সেটি নিশ্চিতভাবে জেনে যায় যুক্তরাষ্ট্র।
- আরো পড়ুন: ব্যাটল অফ মিডওয়ে (পর্ব-২)
লেখা: সমরাঙ্গন অবলম্বনে এম আর নাইন।
নিয়মিত রোমাঞ্চকর সামরিক বিষয়ক পোষ্ট পেতে লাইক দিন আমাদের ফেইসবুক ফ্যান পেইজে- Click here
সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল► Shohan MonsteR |