সেনাবাহিনীর অস্ত্র তৈরির কারখানা বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী

প্রত্যেকটি দেশের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে সেই দেশের অস্ত্র নির্মাণ কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে।যেসমস্ত দেশের অস্ত্র নির্মাতারা যত বেশি আধুনিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগানোর স্বাধীনতা সম্পন্ন,সেসমস্ত দেশের সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনী তত বেশী শক্তিশালী ও আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম।এর প্রমাণ হিসাবে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকানোই যথেষ্ট।

বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী।১৯৭০ সালে চীনা সহায়তায় পাকিস্তান আর্মড ফোর্সেস ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরে উদ্বোধন করে এই অস্ত্র নির্মাণ কারখানা।এই কারখানার নির্মাণ কাজ অবশ্য ১৯৬৮ সালেই শুরু হয়েছিলো। সমগ্র নির্মাণ কাজে পাকিস্তানকে চীন অর্থনীতি ও কারিগরি দুইভাবেই সাহায্য করে।
বলাবাহুল্য,পাকিস্তানিরা এই কারখানা নির্মাণের পর বেশি দিন এর থেকে উপকৃত হতে পারে নাই।১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিসেনানী বনাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়ে এই অস্ত্র কারখানা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর আশির দশকে এই কারখানাকে ব্যাপক আধুনিকীকরণের পাশাপাশি উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হয়।তৎকালীন সরকারসমূহ এই কাজে দারুণ ভূমিকা রাখে এই কথা স্বীকার করতেই হবে।

প্রজেক্ট বাংলাদেশ - ০৮ তথা প্রজেক্ট বিডি-০৮ এই অস্ত্র কারখানার অন্যতম স্মল আর্মস প্রজেক্ট।যেখান থেকে বর্তমান বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সার্ভিস রাইফেল হিসাবে আধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল বিডি-০৮ ( অ্যাসল্ট অথবা লাইট মেশিনগান দুই ভাবে ব্যবহার যোগ্য,ভারতীয় সেনার সার্ভিস রাইফেল ইনসাস থেকে বহুগুণ কার্যকরী) এর জন্ম হয়।যদিও বিডি-০৮ কালাশনিকভ সিরিজের চায়নিজ ভার্সন থেকে আগত,কিন্তু আদতে বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী এতে অনেক আধুনিক ফিচার সংযোজন ও কাঠামোগত রূপান্তর করে দারুণ একটি মারণাস্ত্রে পরিণত করেছে।বিশেষ করে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আফ্রিকান কিছু দেশের সেনারা বিডি-০৮ ব্যাবহারের সুযোগ পেয়েছে।কথিত আছে,এর পর থেকে এই রাইফেল তাদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়।ইউরোপীয়ান অতিমূল্যবান রাইফেল থেকে কম মূল্যের হলেও বেশ কার্যকরী এই অস্ত্র আফ্রিকা মহাদেশের এসকল দেশের জন্য খুবই উপযোগী বলে মনে করি।

চীনা প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহায়তায় তৈরী অস্ত্র নির্মাণ কারখানাটি বর্তমানে পশ্চিমা প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে।যা কারখানার সক্ষমতা পূর্বের থেকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।বর্তমানে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট,বুলেটপ্রুফ হেলমেট ও হ্যান্ড গ্রেনেড ( আর্জেস-৮৪) ও এখানে তৈরী করা হয়।

আকর্ষণীয় বিষয় হলো,বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী অত্যাধুনিক চীনা ম্যান পোর্টেবল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা ম্যানপ্যাডসের ট্রান্সফার অব টেকনোলজি বা TOT নেওয়ার কারণে নিজ দেশেই এই অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণে সক্ষম।এফএন-১৬ নামক এই ভেরি শর্ট রেন্জ এয়ার ডিফেন্স কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বহুল পরীক্ষিত।বিশেষত সিরিয়ায় এর পুরাতন ভার্সন এফএন-৬ এর সফলতার রেকর্ড বিদ্যমান।

বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান যেখানে সামরিক বাহিনীর জন্য প্রচুর পরিমাণ ক্ষুদ্রাস্থ ও তার অ্যামিউনিশন ছাড়াও মেশিন গান ও অন্যান্য ভারী অস্ত্র ও উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও,বিডি-৭১ নামক একপ্রকার প্যারাসূট ও তৈরী করা হয় যা আমাদের প্যারাট্রুপাররা ব্যবহার করে থাকেন।

বিডি-১৪ জেনারেল পারপাস মেশিনগান ( GPMG) এই অস্ত্র কারখানার অন্যতম উৎপাদিত অস্ত্র।পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে নানান যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহ্রত চীনের টাইপ-৮০ বা রাশিয়ার টাইপ-৬৭ এর লাইসেন্সড ভার্সন বাংলাদেশের বিডি-১৪ মেশিনগান।এই জাতীয় মেশিনগান চীনা সেনাবাহিনীর এয়ারবোর্ন ইউনিট ও ব্যবহার করে থাকে।

বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরী থেকে ইতিমধ্যেই পৃথিবীর নানান দেশ অস্ত্র কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের সেনাবাহিনীর কাছেই আমাদের বিডি-০৮ অ্যাসল্ট রাইফেল/লাইট মেশিনগান স্বপ্নের মতো।আমাদের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরীতে এগুলোর পাশাপশি আর্টিলারী অ্যামিউনিশন ( যেমন মর্টারে ব্যবহ্রত শেল) ও স্বল্প পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরী করা হচ্ছে।

এছাড়াও,গাজীপুরস্থ এই ফ্যাক্টরীতে ড্রোন ও নির্মাণ করা হয়ে থাকে।যা সেনা,নৌ ও বিমানবাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণকালীন সময়ে টার্গেটের কাজ করে।এছাড়াও এসমস্ত ড্রোন দ্বারা যুদ্ধক্ষেত্রে সার্ভেইল্যান্সের কাজ ও চালানো যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিস রাইফেল হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিডি-০৮।এর পাশাপাশি আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলার অংশ হিসাবে টেকনোলজি সহ অন্য কোনো অ্যাসল্ট রাইফেল ও কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর।এসম্পর্কিত টেন্ডারে সম্ভাবনার শীর্ষে রয়েছে ইটালিয়ান বেরেটা এআরএক্স-১৬০ এবং রাশান একে সিরিজের অাধুনিক সংযোজন একে-১৫।দেখা যাক,গাজীপুরের কারখানার জন্য কোন রাইফেলটা সেনাবাহিনী পছন্দ করে😊

এই স্বনামধন্য অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কমান্ড্যান্ট হিসাবে একজন মেজর জেনারেল পদবীর কর্মকর্তা কাজ করেন।বর্তমান প্রধান হলেন মেজর জেনারেল শেখ পাশা হাবিব উদ্দীন।

লেখাঃ আধুনিক সমরাস্ত্র অবলম্বনে এমএম৪৪

নিয়মিত রোমাঞ্চকর সামরিক বিষয়ক পোষ্ট পেতে লাইক দিন আমাদের ফেইসবুক ফ‌্যান পেইজে- Click here



Powered by Blogger.