ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলার অকুতোভয় সৈন্যদল (বিশেষ পোষ্ট)

দ্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমী ও অকুতোভয় একটি সেনাদলের নাম।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্ট থেকে শুরু করে এরপর ৮০'র দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের দূর্গম পাহাড় পর্যন্ত এই রেজিমেন্টের নির্ভীক সেনানীদের বুকের তাজা রক্তে লেখা হয়েছে বাংলার মাটির সন্তানদের বীরত্ব গাঁথা।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাস মানেই একটি সমৃদ্ধ ও সফলতায় পরিপূর্ণ ইতিহাস।দুনিয়ার খুব কম দেশের খুব কম সেনাবাহিনীতেই এমন অজেয় ইউনিট বর্তমান আছে যাদের ইতিহাস এতোটা সমৃদ্ধ।ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাস বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৃষ্টির ও বহু আগের।জানার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

যখন বার্মা ফ্রন্টে ব্রিটিশ কলোনিয়াল আর্মির তরুণ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন এম এ গণি ( পরবর্তীতে মেজর পদে উন্নীত হন) ও অপর কর্মকর্তা এসইউ খান ১২৫৬ ও ১৪০৭ বেঙ্গলী মুসলিম কোম্পানি দুটোকে সাথে নিয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্যান্য নামজাদা ইউনিট গুলোর সাথে কাঁধ মিলিয়ে বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন।

বলে রাখা ভালো,এই ফ্রন্টে ব্রিটিশদের থেকে তথাকথিত যোদ্ধা জাত বা মার্শাল রেস খেতাব পাওয়া গোর্খা ও শিখসেনার ইউনিট ও ছিলো।যাইহোক,ব্রিটিশ সামরিক কর্তাদের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হয়,যখন তারা দেখে,দূর্বল ও সামরিক বাহিনীতে কাজ করার যোগ্য নয় বলে যে জাতিকে তারা অবহেলা করেছিলো,তাদের ছোট্ট দুই কোম্পানি পরিমাণ শক্তি কি ভয়ানক বিভীষিকা হয়ে উঠেছে প্রতিপক্ষ দূ্র্ধর্ষ জাপানিদের বিরুদ্ধে!

সে যাই হোক,যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ভারতীয় পাইওনিয়ার কোরের সাথে এই দুটি বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে গঠিত কোম্পানিও নর্দার্ন ইন্ডিয়ার কোর সেন্টারে কমান্ড্যান্ট ম্যারিয়াট্টির অধীনে অবস্থান নেয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ আগ্রাসনের অবসান ও পাকিস্তান সৃষ্টি হলে এই দুটি বাঙালি কোম্পানি ঢাকার পিলখানা ও কুর্মিটোলায় অবস্থান নেয়।এখানে বসেই ক্যাপ্টেন এম এ গণি অবহেলিত বাঙালি মুসলিমদের নিয়ে সেনাবাহিনীতে পদাতিক রেজিমেন্ট গঠনের ঐতিহাসিক চিন্তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন।প্রস্তাবটি তিনি পত্রাকারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার ইন চীফ মেজর জেনারেল ম্যাজারভির কাছে পাঠিয়ে দেন।যেখানে তিনি বর্তমানের দুটি পাইওনিয়ার মুসলিম কোম্পানিকে কেন্দ্র করে একটি বাঙালি সেনাসদস্যদের নিয়ে তৈরী রেজিমেন্ট গঠনের আশা প্রকাশ করেছিলেন।

কমান্ডার ইন চীফ তাঁর ফিরতি পত্রে ক্যাপ্টেন গণিকে সম্মতিসূচক কথাবার্তা লিখেন।যার ভেতর অন্যতম একটি বাক্য হলো- " আমি আশা করি তুমি পৃথিবীকে দেখাতে পারবে যে বাঙালি মুসলিম সেনারা কোনো অংশেই অন্য সেনাদের চেয়ে কম নয় "। স্যর ম্যাজারভির এই বাক্য পরবর্তীতে কাটায় কাটায় সত্যে পরিণত হয়েছিলো।ইস্ট বেঙ্গল দেখিয়ে দিয়েছিলো,আমার সেনারা কারো অংশে কম নয়,বরং কিছু বেশিই অনেকের চেয়ে।

৪৭ এর সেপ্টেম্বরে মেজর এম এ গণি ( প্রোমোটেড) ও ক্যাপ্টেন এস ইউ খান এই দুটি কোম্পানিকে কুর্মিটোলায় একত্র করেন।এদের কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৃষ্টি হয়।এর আগে এম এ গণি ক্যাপ্টেন থাকাবস্থাতেই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন।দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েই তিনি একটি রিক্রুটিং টিম নিয়ে পূর্ব বাংলার শহর-গ্রাম চষে ফিরেন বাংলা মায়ের সৎ ও সাহসী তরুণ সন্তানদের খোঁজে।

১৫ ই ফেব্রুয়ারী-১৯৪৮ এ তরুণ বাঙালি রিক্রুট ও সেনাদের নিয়ে গঠিত এই সেনাদলকে অফিশিয়ালি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামকরণ করা হয়।শুরু হয় ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা দ্য সিনিয়র টাইগার্সের আনুষ্ঠানিক যাত্রা।লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসন ইউনিটের ইতিহাসের প্রথম কমান্ডিং অফিসার ( সিও) হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৯ এ জুনিয়র টাইগার্স নামে আত্মপ্রকাশ করে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।এই দুই ব্যাটালিয়নের আত্মপ্রকাশের পর নবীন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে ১৯৫০ এর পহেলা জুন গঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার তথা ইবিআরসি।

রেজিমেন্টের প্রথম কর্নেল কম্যান্ড্যান্ট ছিলেন মেজর জেনারেল ওমরাও খান।রেজিমেন্টের কমান্ডারকে পাপা টাইগার হিসাবে ডাকা হয়।ইতিহাসের প্রথম পাপা টাইগার ছিলেন মেজর কাজী আব্দুল খালেক এবং প্রথম সার্জেন্ট মেজর ছিলেন অনারারি ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ নুরুল হক,বীর প্রতীক।

বাঙালি সেনাদের বীরত্বের ইতিহাস বহু পুরাতন।অফিসিয়ালি বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামকরণের পর তাঁদের বিভিন্ন যুদ্ধে কখনো দেশমাতৃকাকে রক্ষায়,আবার কখনো দেশকে শত্রু মুক্ত করতে বীরত্বপূর্ণ অবদানই এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।

ভারত-পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ছিলো অফিসিয়ালি বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ।এই যুদ্ধ বাঙালির সামরিক ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।কাসুর-খেমকারানের মাটিতে লাহোরে বিষদাঁত বসাতে আগুয়ান শত্রু নিধনে মেতে ওঠা বীর বাঙালির সেই বীরত্বগাথা সমগ্র পাকিস্তানের রেডিওতে সার্বক্ষণিক হ্রদয়গ্রাহী ভঙ্গিমায় সম্প্রচারিত হয়।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্যান্য দলসমূহের সমস্ত দম্ভ চূর্ণ করে লাহোরের দোরগোড়ায় যখন শত্রু পৌছে গেছে,তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অবহেলিত দ্য টাইগার্সরা কিভাবে তাদের প্রতিহত করলো,তা ছিলো সেসময় সমগ্র পাকিস্তানবাসীর জন্য বিস্ময়।সিনিয়র টাইগার্সরা সত্যিই সেদিন বাঘের ন্যায় ঝাপিয়ে পড়েছিলো শত্রুর ওপর।বুকে মাইন বেঁধে ট্যাংকের নিচে নিজেকে সঁপে দেওয়ার মতো বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে সেদিন দ্য বেঙ্গল টাইগার্সরা।

৬৫'র যুদ্ধে সেই অবহেলিত বাঙালি সেনারা অন্যান্য পাকিস্তানি তথাকথিত শক্তিশালী সেনাদলগুলোকে পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ সংখ্যক বীরত্বের পদক ছিনিয়ে নেয়।দুজন সিতারা ই জুরাত ও ৭ জন তামঘা ই জুরাত সহ এই রেজিমেন্টের ৪ ব্যাটালিয়নের মোট ১৩৬৭ জন সেনা ছিলো সমগ্র পাকিস্তানের জন্য তখন বিস্ময়।চট্টগ্রামের টাইগার মিউজিয়ামের সামনে আজ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে খেমকারানের যুদ্ধক্ষেত্রে বেঙ্গল টাইগার্সের জব্দ করা ট্যাংক বিদ্যমান।

এরপর সাগরে বহু পানি গড়িয়েছে ৬ বছরে।৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৬ শে মার্চ রাতে ঘৃণিত সেই অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে বাঙালিকে আরো একবার অধীনস্থ করার স্বপ্নে বাঁধ সাধে দ্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।সিনিয়র-জুনিয়র-মাইনর ও বেবি টাইগার্স ( যথাক্রমে ১-২-৩-৪ বেঙ্গল রেজিমেন্ট) ও দ্য পাইওনিয়ার্স খ্যাত ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা মহান মুক্তিযুদ্ধে কসাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়ে যায়।এই পাঁচ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রতীক হিসাবে কলারে মেরুন বর্ণ পাইপিন ধারণ করেন।মহান মুক্তিযুদ্ধে এই রেজিমেন্টসমূহের সেনানীদের মধ্য হতে ২ জন বীর শ্রেষ্ঠ ও ৩৪ জন বীর উত্তম এবং ৭৮ জন বীর বিক্রম সহ ১৩৯ জন বীর প্রতীক খেতাব হাসিল করেন।মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহন আরো একবার পৃথিবীর সকল জাতিকে মনে করিয়ে দেয়,বাঙালি কারো অনুগত হয় না।কারো জোরপূর্বক বশ্যতা মানে না।বাঙালিকে বশ মানাতে এলে তার ফল ও ভালো হয় না।

এখন আপনাদের সামনে তুলে ধরবো দ্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তথা পুরো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক অজানা ইতিহাস।পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন সবুজাচ্ছাদিত পাহাড়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বীরত্বের কয়টা গল্প আমরা জানি?পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউন্টার ইনসার্জেন্সি অপারেশন চলাকালীন চরম বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনকরায় শুধুমাত্র এই রেজিমেন্ট থেকেই সর্বমোট ১৯০ জন সেনাকে বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ খেতাব দেওয়া হয়েছে।এর মধ্যে ৬ জন বীর উত্তম,৩৫ জন বীর বিক্রম ও ১৪৪ জন বীর প্রতীক রয়েছেন!
আমরা কয়জনের ঘটনা জানি?

এছাড়াও বিশ্ব শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘের হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৭ টি ব্যাটালিয়নের ৩০ হাজার সদস্য কুয়েত,মোজাম্বিক,সোমালিয়া,বসনিয়া,হাইতি,সিয়েরালিয়ন,আইভরি কোস্ট ও সুদান সহ পৃথিবীর নানান প্রান্তে সফলতার সাথে কাজ করে গেছেন।বাংলাদেশের বিশ্ব শান্তিরক্ষায় অবদানের জন্য যে সুনাম ও নামডাক,তার অধিকাংশ এই ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ রেজিমেন্টের অবদান।

ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার সামরিক ইতিহাস দারুণ সমৃদ্ধ।আমরা সেই বাঙালি জাতির অংশ,যাদের ছিলো ঈসা খানের মতো বীর।আমরা সিপাহী বিদ্রোহ কারী বাঙালি।বাঙালি যুগে যুগে তার জাত চিনিয়েছে।সাম্রাজ্যবাদীদের তথাকথিত মার্শাল রেস খেতাব না পাওয়াতে বাঙালির কিছুই আসে যায় না।

---- সিংহের একদিনের জীবন শৃগালের হাজার বছরের জীবন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ----

লেখাঃ আধুনিক সমরাস্ত্র অবলম্বনে এমএম৪৪

নিয়মিত রোমাঞ্চকর সামরিক বিষয়ক পোষ্ট পেতে লাইক দিন আমাদের ফেইসবুক ফ‌্যান পেইজে- Click here


Powered by Blogger.